জামিলউদ্দীন আহসান, বীর প্রতীক
কুশলী ও দক্ষ এক মুক্তিযোদ্ধা
শীতের রাত। ঘন কুয়াশায় ঢাকা প্রান্তর। তখন রমজান মাস। মুক্তিযোদ্ধারা মধ্যরাতে সেহির খেয়ে বেরিয়ে পড়লেন শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের উদ্দেশে। তাঁদের নেতৃত্বে জামিলউদ্দীন আহসান। তাঁরা কয়েকটি উপদলে বিভক্ত। ৮ নম্বর প্লাটুন দক্ষিণে সালদা নদী রেলস্টেশন ও নয়নপুর বাজার বরাবর, ৯ নম্বর প্লাটুন উত্তরে দেউস বরাবর। এর মাঝে ৭ নম্বর প্লাটুন। এই প্লাটুনের সঙ্গে আছেন জামিলউদ্দীন আহসান।
মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের কাছাকাছি যাওয়ামাত্র তারা গোলাগুলি শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করলেন। তাঁদের ৯ নম্বর প্লাটুন উন্মুক্ত ধানখেতে এবং ৭ নম্বর প্লাটুন পরিত্যক্ত গ্রামে অবস্থান নিয়ে গুলি করতে থাকল। ৮ নম্বর প্লাটুন দক্ষিণে সুবিধাজনক অবস্থানে। পাকিস্তান সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ৭ ও ৯ নম্বর প্লাটুনের ওপর ক্রমাগত আর্টিলারি এয়ার বার্স্ট শেলিং করতে থাকে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে জামিলউদ্দীন আহসান ওই দুই প্লাটুনকে পেছনে সরে যেতে বললেন। মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে সরে গেলেন।
এর মধ্যে ভোরের আলো ফুটেছে। জামিলউদ্দীন আহসান ৭ নম্বর প্লাটুন নিয়ে ৮ নম্বর প্লাটুনের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাঁদের সঙ্গে থাকা মর্টার, রকেট লাঞ্চার দিয়ে সালদা নদীর অন্য পাশে রেলস্টেশন ও নয়নপুর বাজারে আক্রমণ চালালেন। ৮ নম্বর প্লাটুনের মেশিনগান পাকিস্তানিদের রেলস্টেশনের মেশিনগান পোস্ট অকার্যকর করে দিল। মুক্তিবাহিনীর মর্টার ও আর্টিলারি ‘মুজিব ব্যাটারির’ অবিরাম ও অব্যর্থ শেলিং তাদের তটস্থ করে ফেলল।
ক্রমেই বেলা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ল। তারা তাদের অবস্থান ছেড়ে পালাতে শুরু করল। জামিলউদ্দীন আহসান দেখতে পেলেন, আহত ও নিহত সেনাদের নিয়ে শত্রুরা পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের ধাওয়া করতে পারলেন না। কারণ, মাঝে নদী। তিনি মুক্তিবাহিনীর অন্য দলকে জানালেন, পলায়নরত পাকিস্তানিদের আক্রমণ করার জন্য। সম্মিলিত সাঁড়াশি আক্রমণে দুপুরের মধ্যেই সালদা নদী ও নয়নপুর বাজার এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত হলো।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর। সালদা নদীতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত সালদা নদী। ১৯৭১ সালের জুন-জুলাই থেকে এখানে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট মুখোমুখি শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল। দুই অবস্থানের মধ্যে ছিল সালদা নদী ও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ। মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অসংখ্য সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাঁচজন পাকিস্তানি সেনার মৃতদেহ উদ্ধার ও তিনজন রাজাকারকে বন্দী করেন। অনেক অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ তাঁরা দখলে নেন। মক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে এলএমজিম্যান সিরাজ শহীদ এবং একজন আহত হন।
জামিলউদ্দীন আহসান ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। জুনের শেষে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ারকোর্সে অন্তর্ভুক্ত হন। প্রশিক্ষণ শেষে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। এ সময় চুনারুঘাট চা-বাগানের যুদ্ধে অংশ নেন। পরে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, নাজিরহাটে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য জামিলউদ্দীন আহসানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৪। তিনি জামিল ডি আহসান নামে পরিচিত।
জামিলউদ্দীন আহসান ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর নেন। প্রেষণে রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলায়। বর্তমানে ঢাকার মহাখালী ডিওএইচএসে (বাড়ি ৪৩৫, সড়ক ৩০
বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম মুহাম্মদ জসিমউদ্দীন, মা হুসন আরা জেসমিন। স্ত্রী বীথি জামিল। তাঁদের দুই ছেলে।