সুষুপ্ত পাঠক - টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান... | Facebook
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে দেখি বিড়াট সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। আইয়ূব বাচ্চুর কিছু কথা নিয়ে প্রথম শোরগোল উঠে। দর্শকরা তার গান শুনে হাততালি দেয়নি, কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি বলে তিনি অভিমান ভরে বলেছেন, এই তালিটুকু তুলে রাখুন অন্যের জন্য। বাংলা গান যে শুনছেন তাতেই ধন্যবাদ…ইত্যাদি ইত্যাদি…। এসব শুনেই দেশপ্রেমিক ফেইসবুকারদের রোষাণলে পড়েছেন সাধারণ দর্শক। দর্শকদের দোষটা কোথায় বুঝলাম না। আইয়ূব বাচ্***ের কনর্সাটে মানুষের ঢল কিভাবে নামতো সে সুখ স্মৃতি বোধহয় আইয়ূব বাচ্চুরাই এখন রোমন্থন করেন নিরালায়। স্মৃতি রোমন্থন করেন কারণ এখন আর সে ঢল তারা নামাতে পারেন না। প্রশ্ন হচ্ছে কেন পারেন না? এমন কি ঘটলো যে দর্শক-শ্রোতা মুখ ফিরিয়ে নিল?
জাতিগতভাবে আমরা বোধহয় আত্মসমালোচনা করতে অক্ষম। গত দশ বছরে আইউব বাচ্চুর এমন কোন গানের কথা বলতে পারবেন যা মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে? এমন কোন সৃষ্টি তিনি করেছেন যা বাংলা গানের বাজারের মন্দা কাটিয়ে ক্যাসেট বিক্রির জোয়ার তুলেছে?
এলআরবির এ্যালবাম বের হলে আগে কি ঘটতো যারা বাংলা ব্যান্ড সংগীত এক সময় শুনতেন তারা ভাল করে জানেন। ১৫-২০ বছরের আগের “সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে” দিয়ে আর কতদিন পাবলিককে বুঁদ করে রাখবেন? ৭৫ হাজার টাকার টিকিট কেটে এসব শুনতে কেউ যায়নি। এ আর রহমানকেই দেখতে গেছে। আমি বলবো আইউব বাচ্চু সহ বাংলা সংস্কুতি জগতের যারা আজ হতাশায় আহা উহু করছেন তারা নিজেদের ব্যর্থতাকে দেখতে পারছেন না। দর্শক তো পণ করেনি বাংলা কিছু দেখবে না, শুনবে না। প্রশ্ন করুন, যারা গান করেন, সিনেমা বানান, নাটক বানান, কেন দর্শক-শ্রোতা মুখ ফিরিয়ে নিচেছ। উত্তর পাবেন আশা করি।
“দর্শক”, “শ্রোতা”, “পাঠক” এদের আসলে কোন দেশ নেই, জাত নেই, শ্রেণী নেই, জাতীয়তাববোধ নেই, দেশপ্রেম নেই…। থাকলে পাকিস্তানীরা ভারতীয় সিনেমার জন্য এত পাগল থাকতো না। আমরা বাংলাদেশীরাও কষে রোজ দুবেলা ইন্ডিয়াকে গালি দিয়ে ভারতীয় সিনেমা-টিভি দেখতাম না। আসলে আমরা ভাল কিছু করতে পারি না। আমাদের এখানে কোন কম্পিটিশন নেই। এখানে তারকা তৈরি করে দেয়া হয় তারপর মঞ্চে গিয়ে পারফর্ম করে। ভারতে একজনকে তার প্রতিভার দিয়ে যতটা কষ্ট করে সারা ভারতে পরিচিতি পেতে হয় বাংলাদেশে তার চারআনাও কষ্ট করতে হয় না। সরচেয়ে বড় কথা কম্পিটিশিন নেই বলে ভাল করার কোন তাগিদ নেই।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের বছর ভারতীয় সিনেমা বন্ধ হয়ে যায় আমাদের দেশে। দেশ স্বাধীন হবার পর চাষী নজরুল ইসলামরা বঙ্গবন্ধুকে গিয়ে অনুরোধ করেন যেন বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা না চলে। তাতে নাকি বাংলা সিনেমা দাঁড়াতে পারবে না। বাংলা সিনেমা এখন দাঁড়ানো তো দূরের কথা কফিনে চলে গেছে। পাকিস্তান আমলে উর্দু সিনেমার সঙ্গে কম্পিটিশন করে বাংলা সিনেমা তীব্র প্রতিযোগিতায় বাঙালি দর্শককে হলে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। বাংলা সিনেমার অভিনেতা, পরিচালকরা উর্দু ছবির প্রচন্ড চাপকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে লড়াই করেছিলেন। উর্দু সিনেমার মহা তারকাদের টপকে এদেশের তরুণ-তরুণীরা রহমান-রাজ্জাক, কবরী-শাবানাকে আইডল করে নিয়েছিল। বাংলা সিনেমার লোকজন আইউব বাচ্***ের মত অভিমান দেখায়নি, জাতীয়তাবাদ উস্কে দেয় নি, তারা তাদের কাজটা করে গিয়েছিল। যে কোন দেশের মানুষ তার নিজের ভাষার শিল্প-সাহিত্যে-সিনেমায় সবচেয়ে বেশি আগ্রহী থাকে। সবাই চায় তার ভাষায় সিনেমা-নাটক দেখতে। আমরা গত ৪২ বছরে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে কথিত আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করে চেয়েছি। আধুনিক পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের আসলে কোন ধারনাই নাই। আজকের যুগে যে কোন কিছু ঢেকে রাখা যায় না, লুকিয়ে রাখা যায় না সেটা বেমালুক ভুলে বসে আছি। আমাদের সিনেমা হলে হলিউডের সিনেমা চলে, সারাদিন টিভিতে হিন্দী সিনেমা চলে শুধু সিনেমা হলে হিন্দী সিনেমা চলতে পারবে না। তাতে নাকি বাংলা সিনেমা মরে যাবে। এখন আওয়াজ উঠছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোই বন্ধ করে দেয়া হোক। বিপদ দেখেন, শুধু হিন্দীই বাংলাদেশীদের শত্রু নয়, ভারতীয় বাংলা সিনেমাও তাদের বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিয়েছে! এই ভারতী বিদ্বেষী দেশেই এটা হয়েছে। আগেই বলেছি, দর্শক-শ্রোতার কোন দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদী, ধর্ম, শ্রেণী নেই। আইয়ূব বাচ্চুর জন্য আমার কষ্টই হয়। কবে তারা বুঝবেন, দর্শক-শ্রোতা কারুর কাছে নকে খত দিয়ে বসে নেই, ভাল যা তারা তাই গ্রহণ করবেন। গান গাওয়ার আগে হাত জোর করে, “প্লিজ, আপনারা বাংলা গান শুনুন, হিন্দী গান শুনবেন না”-এসব বলে বাংলা গান বাঁচাতে পারবেন না। ভুল বললাম আসলে, কথাটা হবে “বাংলাদেশী বাংলা গান”, কারণ কোলকাতায় হিন্দী সিনেমা ও গানের বিড়াট চাপ স্বত্ত্বেও সেখানে বাংলা গান ও বাংলা সিনেমার গান ঠিকই মার্কেট করে নিয়েছে। খোদ বাংলাদেশে কোলকাতার বাংলা গান, তাদের সিনেমার বাংলা গান সবাই শুনছে। এখানেও দেখার বিষয় বাংলাদেশে বাংলা গান চলছে! তবে সেটা “ভারতীয় বাংলা”, “বাংলাদেশী বাংলা”ই হালে পানি পাচ্ছে না। এবার তাহলে হিন্দী বিরাগটা বুঝা যাবে, বাংলাপ্রেমিদের তো বাংলা গানে কোন এ্যালার্জি থাকার কথা নয়? কিন্তু দেখা যাচ্ছে এখানে কোন দেশপ্রেম, বাংলা ভাষা প্রেম নেই, স্রেফ বাণিজ্য। পাবলিক আর তাদের খাচ্ছে না! আর কাহাতক “সেই কোন দরদিয়া আমার” শুনতে টিকিট কাটবে লোকে?
মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী তো বাংলা টিভি নাটকের অদ্ভূত ভাষা ও স্কিপ্টহীন নাটকের ধারনা দিয়ে টেলিভিশন নাটকেকে আগেই *** মেরে দিয়েছেন। পাবলিক আর কি করবে, জি-বাংলায় ‘রাশি’ আর স্টার জলসায় সন্ধ্যাবেলায় বুঁদ হয়ে বসে থাকে। এ জন্য কি কান্নাকাটি টিভি নাটক নির্মাতাদের! সরকারের কাছে কতবার আকারে-ইঙ্গিতে আবদার করেছে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করে দেয়ার। অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছে, ভারতে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখানো হয় না। আরে বাবা নিজের দেশেই তো কেউ তোমাদের কিছু দেখে না! সবাইকে স্মরণ করতে বলছি, এক সময় কোলকাতার মানুষ বাংলাদেশের বিটিভি দেখার জন্য টিভি এ্যানটিনায় সরা-হাড়ি-পাতিল বাঁধতো।এই অপদার্থর দল সেই স্বর্ণ যুগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। কোলকাতা ভারতের একটা প্রদেশ, সেখানে হিন্দীর দাপটে টেকাই দায়। তারা তো আর বলতে পারবে না হিন্দী সিনেমা দেখানো বন্ধ করো। তারা বাংলা সিনেমাকে বাঁচানো তাই একটাই কৌশল জেনেছে, ভাল সিনেমা, এমন সিনেমা বানাতে হবে, যাতে দর্শক হিন্দী সিনেমার পাশাপাশি বাংলা সিনেমা দেখে। অবাক বিষয় হলো, এখন বাংলা সিনেমার পাশাপাশি লোকে হিন্দী সিনেমা দেখছে! এফডিসিঅলারা এসব কানে তুলবে না জানি। পারবে শুধু নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে।
জেমস যখন সারা ভারত জয় করে এসেছিল তখন আপনি বাংলাদেশী খুব গর্ব অনুভব করেছিলেন না? যারা বাংলাদেশে ভারতীয় শিল্পীদের পারফর্মকে সহজভাবে নিতে পারেন না, তারা বাংলাদেশের শিল্পীদের ভারতে গিয়ে পারফর্মকে নিয়ে উচ্ছ্বাস করেন কিভাবে? জেমস তার প্রতিভা দিয়ে গোটা ভারতবর্ষকে নিজের প্রতিভার পরিচয় দেখিয়েছে। এটা ভারতীয় সিনেমা বা গণমাধ্যম ছাড়া কখনই সম্ভব নয়। এই বাস্তবতা মানতেই হবে যে ভারতীয় গণমাধ্যম ছাড়া আপনি বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছতে পারবেন না। পাকিস্তানী শিল্পীদের তাই ভারতীয় সিনেমায় কাজ করে বিশ্বব্যাপী পরিচিত লাভ করতে হয়। আমরা কি অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পারি না কোন বাংলাদেশী ভারতীয় সিনেমার প্লেব্যাকের শীর্ষস্থানীয় শিল্পী? জেমস যা শুরু করেছেন তার অগ্রগতি চাই না এটাই ইতিহাস হয়ে থাক তাই চাই? নিজে গোড়া জাতীয়তাবাদী হয়ে বড় মঞ্চে যাবার কথা ভাবা যায় না। আমরা যখন উপমহাদেশের ছোট ছোট বাজারগুলোকে এক করে বিশাল একটা বড় বাজার কল্পনা করতে চাই তখন ভেসে যাওয়ার, ভারতের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়ার ভয়ের কথা বলি। অযোগ্য, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অপারগরা ছিটকে তো যাবেই। বোকা দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদ আজকের প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে, মুক্ত ও অবাধ সংস্কৃতির যুগে টিকে থাকার আসল দাওয়াই নয়। আসল দাওয়াই হচ্ছে আপনি আসলে কিছু দিতে পারেন কিনা। যদি আপনার আসলেই দেয়ার কিছু থাকে তাহলে দর্শক কোনদিন তা ফেলে দিবে না। দর্শকদের প্রতি যাদের বিশ্বাস নেই, তারা বুক ভরা অভিমান নিয়ে কান্নাকাটি করতে পারে।চতুরের মত জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে সাময়িকভাবে হয়ত নিজেদের পিঠ বাঁচাতে পারবে কিন্তু শেষ বিচারে নিজেদের অস্তিত্বকে বাঁচাতে পারবে কি?