পলাশী নাটকের গ্রীণরুমে
ডক্টর মোহর আলী লিখেছেন- দুই অপশক্তি অতি সন্তর্পণে এক অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলে। উভয় দলের উদ্দেশ্যের ভিন্নতা থাকা সত্বেও তাদের লক্ষ্য ছিল এক। সেটা হলো সিরাজের পতন অনিবার্য করে তোলা। একটির উদ্দেশ্য ছিল শোষণ লুণ্ঠনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক সাফল্যকে চূড়ান্ত করার জন্য ঔপনিবেশিক প্রভুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা। অন্যটির উদ্দেশ্য ছিল সিরাজের পতন ঘটিয়ে মুসলমানদের বিনাশ করে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করা। তাদের একটা সহজ হিসেব ছিল মুসলমানরা ভারত বর্ষের যেখানেই প্রবেশ করেছে সেখানকার মাটি ও মানুষের সাথে একাকার হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের শিকড় অনেক গভীরে প্রথিত হয়ে যায়। এজন্য তাদের উৎখাত করা বর্ণ হিন্দুদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। এ কারণে তারা ভাবতে শুরু করল ইংরেজদের সাহায্য সহযোগিতায় মুসলমানদের পতন সম্ভব হলে কালক্রমে বৃটিশদের বিতাড়িত করা তাদের জন্য কঠিন হবে না। কেননা সাতসমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে ভারতে তাদের প্রাধান্য বজায় রাখা বৃটিশদের পক্ষে অসম্ভব হওয়াই স্বাভাবিক। উভয় পক্ষই তাদের আপাত লক্ষ্য অর্জনের জন্য অভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। প্রথম বর্ণবাদী হিন্দুচক্র এবং বৃটিশ বেনিয়া নিজেদের মধ্যে সখ্যতা বৃদ্ধির প্রয়াস নেয় এবং নিজেদের কৌশল সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় করে। এই সাথে বিভিন্নভাবে গুজব ছড়িয়ে নবাবের চরিত্র হননের উদ্যোগ নেয়। সার্বিকভাবে নবাবের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে উভয় পক্ষ।
তৎকালীন বাংলার পরিস্থিতির উপর আলোচনা রাখতে গিয়ে প্রফেসর এমাজউদ্দিন লিখেছেন- তৎকালীন সামাজিক পরিবেশও ছিল ষড়যন্ত্রের উপযোগী। তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে তখন বীরভূম ছাড়া আর সব বড় বড় জায়গাতেই হিন্দু জমিদার ছিল প্রতিষ্ঠিত। প্রকাশ্যে না হলেও ভিতরে ভিতরে প্রায় সব জমিদারই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে প্রধান নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়। বর্ধমানের রাজার পরই ধনে মানে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। বাংলার মহাজনদের মাথা জগৎশেঠদের বাড়ীর কর্তা মহাতাব চাঁদ। জগৎশেঠরা জৈন সম্প্রদায়ের লোক হলেও অনেকদিন ধরে বাংলায় পুরুষানুক্রমে থাকায় তাঁরা হিন্দু সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কর্মচারীদের পাণ্ডা হলেন রায় দুর্লভ রাম।... হুগলীতে রইলো নন্দকুমার।” জগৎশেঠ এবং উমিচাঁদের আশ্রিত ইয়ার লতিফ খাঁ আর একজন ষড়যন্ত্রকারী। সবার শীর্ষে ছিলেন আলীবর্দী খাঁর এক বৈমাত্রেয় ভগ্নীর স্বামী মীর জাফর আলী খাঁ। নবাব হবার বাসনা তার অনেক দিনের। বর্গীয় হাঙ্গামার সময় আলীবর্দী খাঁকে হত্যা করিয়ে বাংলার নবাবী গ্রহণের আকাঙ্খা তাঁর ছিল। শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা ফলবতী হয়নি। সিরাজউদ্দৌলা নবাব হলে জগৎশেঠ শওকত জঙ্গের সাথে মিলে ষড়যন্ত্রের আর এক গ্রন্থি রচনা করেন। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এবারে জগৎশেঠ, ইয়ার লতিফ খাঁ, উমিচাঁদের সহযোগী হিসেবে মাঠে নামেন। সিরাজের সমর্থকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সেনা নায়ক মোহন লাল এবং মীর মদন বা মীর মর্দান (২৩ জুনের পূর্বে বাংলার ‘মুক্তির চুক্তি’ নামে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মীর জাফর এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে। অক্ষয় কুমার মৈত্রের রচিত মীর কাসিম গ্রন্থের ২২৩-২৪ পৃষ্ঠায় ১২ দফার এই চুক্তির বিবরণ রয়েছে। মীর জাফরের স্বাক্ষরে চুক্তিতে বলা হয় : ‘আমি আল্লাহর নামেও আল্লাহর রাসূলের নামে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমার জীবনকালে আমি এই চুক্তিপত্রের শর্তবলী মানিয়া চলিব।’
আগে উল্লেখ করেছি ভারতের মারখাওয়া ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে কিভাবে সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হচ্ছিল কিভাবে তারা তাদের লক্ষ্যের দিকে সন্তর্পণে এগুচ্ছিল সেটা সমকালীন প্রতিষ্ঠিত শাসকরা আঁচ করতে পারেনি। কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদী কুচক্রীদের তোষামোদিতে সম্মোহিত হয়ে ছিল তারা। কিন্তু তৎকালীন পরিস্থিতি সংক্রান্ত গভীর উপলব্ধি ছিল বৃটিশদের। ১৭৫৪ সালে জনৈক ইংরেজ স্কটের পত্র থেকে সেটা জানা যায়। হিন্দু জমিদারদের মনোভাব সম্পর্কে তিনি লিখেন- ‘হিন্দু রাজা ও জমিদাররা মুসলিম শাসকদের প্রতি সর্বদা হিংসাত্মক ও বিদ্রোহী মনোভাব পোষণ করেন। গোপনে তারা মুসলিম শাসনের হাত থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে।’
একই সময় কোম্পানীর একজন মিলিটারী ইঞ্জিনিয়ার তার বৃটিশ কর্তৃপক্ষের নিকট একটি রিপোর্ট পেশ করেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন- ‘যদি ইউরোপীয় সেনাবাহিনী তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্যে সঠিকভাবে হিন্দুদের উৎসাহিত করতে পারে তবে হিন্দুরা অবশ্যই যোগ দিবে তাদের সাথে, উমি চাঁদ ও তাদের সহযোগী হিন্দুরাজা ও সৈন্য বাহিনীর উপর যাদের আধিপত্য কাজ করছে তাদেরও টানা যাবে এ ষড়যন্ত্রে।’ কে কে দত্তের আলীবর্দী এন্ড ‘হিজ টাইম’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে- ‘১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংসহাসন চ্যুত করার ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তুলেছিল হিন্দু জমিদার ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনী লেখক রাজীব লোচন লিখেছেন- ‘হিন্দু জমিদার ও প্রধানগণ সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। [কে, কে. দত্ত. আলীবর্দী এন্ড হিজ টাইম, পৃঃ ১১৮]
পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে ক্লাইভের সাথে বর্ধমান, দিনাজপুর ও নদীয়ার জমিদারদের পত্র যোগাযোগ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে, অগ্রিম আনুগত্য প্রকাশ করে তারা ক্লাইভকে যুদ্ধযাত্রার দাওয়াত জানান [শিরীন আক্তার]। নদীয়া, বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, মেদিনীপুর, দিনাজপুর, বীরভূমের রাজা-মহারাজারা মুর্শিদাবাদ সমবেত হয়ে দেওয়ান-ই-সুবা মহারাজা মহেন্দ্রের কাছে অনেকগুলো দাবী পেশ করেন- তাদের ক্রমবর্ধিষ্ণু দাবী মিটাতে নবাব অপারগ হলে জগৎ শেঠের পরামর্শে তারা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নেতৃত্বে-এক বৈঠকে মিলিত হয়ে সিরাজদ্দৌলাকে উৎখাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সভার পক্ষে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কোলকাতায় মিঃ ড্রেকের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আহবান জানান এবং সর্বমুখী সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন। (Ierrititial Aristocracy of Bangla the Naelia Raj : C.R. 1872 1.V., 107-110.) সুবে বাংলার কুলিন বর্ণহিন্দু রাজা-মহারাজারা আলাবর্দীকে দিয়ে নবাব সরফরাজকে উচ্ছেদ করে যেরূপ ফায়দা হাসিল করেন, নবাব আলীবর্দীর মৃত্যু মুহূর্তেও তেমনি দেওয়ান রাজবল্লভের নেতৃত্বে তাদের একদল সিরাজের বড় খালা ঘষেটি বেগমকে উস্কানি দিয়ে, সসৈন্যে সাথে করে নিয়ে মুর্শিদাবাদ আক্রমণের জন্য নগরীর দ্বারপ্রান্তে হাজির করেন। সিরাজউদ্দৌলা তাঁর খালার মন জয় করে তার সমর্থন পেয়ে যাওয়ায় দিশেহারা দেওয়ান রাজবল্লভ নিজ পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে দিয়ে নবাবের ঢাকাস্থ যাবতীয় অর্থবৃত্ত সম্পদ-সম্ভার কোলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাচার করে দেন। অন্যদিকে সিরাজের খালাতো ভাই পুর্নিয়ার গভর্নর শওকত জংকেও শ্যামসুন্দর বাবুরাই উস্কানি দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ করেন।
ইংরেজদের সাথে বিরোধের সূচনা
আসকার ইবনে শাইখ লিখেছেন- নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে (১৭৪০-৫৬
ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভকে হিসাবপত্র নিরীক্ষণের জন্য কাগজপত্রসহ মুর্শিদাবাদ তলব করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে তহবিল তসরুফের প্রামাণ্য অভিযোগ ছিল। কিন্তু হিসাব পরীক্ষার পূর্বেই তিনি কাশিম বাজারে কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসের নিকট তাঁর পুত্র ও পরিজনের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণ দাস বা কৃষ্ণবল্লভ ৫৩,০০০০০ টাকা মূল্যের নগদ অর্থ ও সোনা রূপাসহ কলকাতায় আশ্রিত হন। এই কৃষ্ণবল্লভকে প্রত্যার্পণের জন্য নবাব দরবার হতে বার বার নির্দেশ ও তাগিদ দেয়া সত্বেও কোম্পানীর গভর্নর রজার ড্রেক তা পালন করতে অস্বীকার করেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ১৭৫৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। নবাবের নিষেধ সত্বেও ইংরেজরা তাদের ফোর্ট উইলিয়াম (কলকাতায়
দুর্গটিকে সামরিক সাজে সজ্জিত করে তুলতে শুরু করে। বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দী এ দুটি ঘটনার ‘প্রতিকার করে যেতে পারেননি।
নবাবী লাভ করেই সিরাজউদ্দৌলা কৃষ্ণবল্লভকে প্রত্যার্পণ করতে গভর্নর ড্রেককে এবং দুর্গ দেয়াল ভেঙ্গে পরিখা বন্ধ করে দিতে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে নির্দেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণ সিংহ নামক একজন বিশ্বস্ত দূতকে ইংরেজদের মনোভাব যাচাই করার জন্য কলকাতা পাঠালেন। কিন্তু ইংরেজরা নারায়ণ সিংহকে অপমান করে কলকাতা হতে তাড়িয়ে দেয়। নবাব আবার অন্যতম ব্যাংক ব্যবসায়ী খাজা ওয়াজিদকে একই উদ্দেশ্যে কলকাতা পাঠান। পরপর চার বার তিনি কলকাতা যান, কিন্তু ইংরেজরা তার সঙ্গেও সংযত আচরণ বা আপোষমূলক মনোভাব প্রদর্শন কোনটিই করেনি।
এভাবে নবাবের আন্তরিক সদিচ্ছা ব্যর্থ হবার ফলে তিনি দুর্লভরাম ও হুকুম বেগকে কাশিম বাজার কুঠি অবরোধের নির্দেশ দিলেন। মির মোহাম্মদ জো খান হুগলীতে জাহাজ নির্গমনের পথ রোধ করলেন এবং নবাবের উপস্থিতিতে কাশিম বাজারের পতন ঘটল। কুঠি প্রধান ওয়াট্স্ এবং কলেটকে সঙ্গে নিয়ে নবাব কলকাতার দিকে অগ্রসর হলেন। কাশিম বাজার অবরোধ ও পতনের মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে ইংরেজদের উপর চাপ সৃষ্টি করাই নবাবের উদ্দেশ্য ছিল। পরবর্তী ঘটনায় তার প্রমাণ মিলে। খাজা ওয়াজিদের মিশন ব্যর্থ হবার পর উর্মিচাঁদ ও শ্রীবাবু নামক জনৈক ব্যবসায়ী সমঝোতার প্রস্তাব দেন। মীমাংসায় আসার জন্য নবাবের নিকট একজন দূত পাঠাতে ড্রেককে অনুরোধ করে পত্র লেখেন উইলিয়াম ওয়াটস্ ও কলেট। এ পত্র পাঠান হয় ওলন্দাজ এজেন্ট বিসডোমের মাধ্যমে। ড্রেক তাও রক্ষা করেননি। অবশেষে ফরাসী দেশীয় ম্যাকুইস দ্যা সেন্ট জ্যাকুইস এর মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠানো হয় কোলকাতায়। উত্তরে উদ্যত রজার ড্রেক প্রস্তাবকারীকে পক্ষ পরিবর্তনের উপদেশ দেন।
সুতরাং অনিবার্য হয়ে উঠল সংঘাত। ১৭৫৬ সালে ১৩ই জুন নবাব ফোর্ট উইলিয়মে পৌঁছান এবং যথারীতি কোলকাতা অবরুদ্ধ হয় ১৯ জুন। নাটকের উদ্ধৃত অহংকারী নায়ক রজার ড্রেক সঙ্গী মিনকিন, ম্যাকেট ও গ্রান্টসহ সগৌরবে পিছন দিকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। সংগে সংগে ইংরেজ শিবিরে পলায়ন প্রক্রিয়া দ্রুত সংক্রমিত হয়ে পড়ে। এক ঘণ্টার মধ্যে ইংরেজদের সকল জাহাজ পলাতকদের নিয়ে ভাটির পথে পাড়ি জমায়...। ... ড্রেক ও অন্যান্যদের পলায়নের পর ফোর্ট উইলিয়ামের মাত্র আটজন যুদ্ধ পরিষদের সদস্য অবশিষ্ট রইল। তাদের মধ্যে হলওয়েল রজার ড্রেকের স্থলবর্তী গভর্নর নিয়োজিত হলেন। হলওয়েল পলায়নের কোন নৌকার অভাবেই কলকাতায় থেকে যেতে বাধ্য হন এবং তিনিই পরবর্তীকালে তথাকথিত কাল্পনিক অন্ধকুপ হত্যার গল্প কাহিনীর জন্ম দান করেন। হলওয়েল গভর্নর হয়ে এক দুপুর টিকে ছিলেন; তার পর আত্মসমর্পন ভিন্ন কিছুই আর তাঁর করবার রইল না। ২০ জুন বিকেল চারটায় কলকাতার পতন ঘটে।
১৭ জুলাই বন্দীদের নবাবের সামনে হাজির করা হয়। অন্যদিকে কাশিমবাজার ও কলকাতার পতন সংবাদ পর পর মাদ্রাজ পৌঁছে। ফলে প্রথমে মেজর কিলপেট্রিক-এর নেতৃত্বে দুটি জাহাজ এবং পরে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে- প্রচুর সৈন্য, গোলাবারুদ ও সাজ-সরঞ্জামসহ বারটি জাহাজ পাঠান হয় বাংলায়। এই অভিযানের প্রধান দুটি উদ্দেশ্য নির্ধারিত হয়;
ক. নবাবের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কোম্পানীর ইচ্ছানুরূপ ক্ষমতা পরিবর্তন।
খ. কোম্পানীর প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসীদের চন্দন নগর হতে উৎখাত। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লিখিত মাদ্রাজের সেন্ট জর্জ কাউন্সিলের লিখিত পত্রে (১৩ অক্টোবর ১৭৫৬
‘The sword should go hand in hand with the pen’ উপদেশের সঙ্গে সঙ্গে নবাবের বিরুদ্ধে যে কোন স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতে এবং ফরাসীদের চন্দন নগর হতে বিতাড়নের নির্দেশও দেয়া হয়।
২৫ ডিসেম্বর ফুলতা পৌঁছেই ক্লাইভ ও ওয়াট্সন ‘কলমের সঙ্গে সঙ্গে তরবারির মহড়া শুরু করেন। ৩০ ডিসেম্বর তাঁরা বজবজ দখল করেন এবং ২ জানুয়ারী (১৭৫৭
কলকাতা পুনরুদ্ধার করে ড্রেক ও তাঁর কাউন্সিল সদস্যদের ফোর্ট উইলিয়ামে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই বিজয়ের গৌরবে ইংরেজেরা ৩ জানুযায়ী নবাব ও তাঁর দেশবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। হুগলী শহরটি ব্যাপকভাবে লুণ্ঠিত হয় এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিনই নবাব তাঁর এক ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে হুগলীর উত্তরে পৌঁছেন। ইংরেজরা ফিরে যায় কলকাতা। ফরাসী ও ওলন্দাজেরা নবাব ও ইংরেজদের বিবাদে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ইংরেজেরা তাদের কাউকে বিশ্বাস না করে এবার খাজা ওয়াজিদের মাধ্যমে তাদের দাবীর কথা জানিয়ে দেয় ২২ জানুয়ারী। বলা হয়, কাশিমবাজার ও কলকাতা দখলের ক্ষতিপূরণ, ১৭১৭ সালের ফরমানানুযায়ী সকল সুবিধা, কলকাতায় সামরিক দুর্গ নির্মাণের অনুমতি এবং কোম্পানীর নিজস্ব মুদ্রা তৈরীর অধিকার দিতে হবে।
বৃটিশদের ঔদ্ধত্য ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে নওয়াব দারুণভাবে বিব্রত ও ক্ষুব্ধ হন। ওদিকে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর আমন্ত্রণে আফগান বীর ভারতবর্ষে আগমন করেন মূলত মারাঠা ঔদ্ধত্য গুড়িয়ে দেয়ার জন্য। তার আক্রমণের লক্ষ্য সুবাহ বাংলা ছিল না। কিন্তু দরবারের কুচক্রী সৃষ্ট আহমদ শাহ আবদালীর বাংলা আক্রমণ সংক্রান্ত গুজব নতুন আশঙ্কার জন্ম দেয়। এ আশঙ্কা নবাবকে অনেকটা হত বিহবল করে ফেলে। উদ্বিগ্ন নবাব আবদালীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেন। সে সময় ইংরেজদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ্য আচরণ নবাবের কাছে গৌণ বলে অনুভূত হয়। নবাব ইংরেজদের সাথে আপোষের কথা ভাবতে থাকেন, এই কারণে যেন আবদালীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে মনযোগী হতে পারেন। ওদিকে নবাবের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার উদ্দেশে নবাব বিরোধী ষড়যন্ত্র পোক্ত হওয়ার জন্য ইংরেজদেরও সময়ের প্রয়োজন ছিল। উভয়ের প্রয়োজনে ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই সন্ধির পর নবাব আফগান আক্রমণ প্রতিরোধে মনোযোগী হলেন। এই অবকাশে ইংরেজরা একদিকে নবাবের পারিষদবর্গ ও সেনানায়কদের প্রলুব্ধ ও প্রভাবিত করার সুযোগ পেল এবং অন্যদিকে ফরাসীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল সম্ভাব্য বিপর্যয় নাটকের দৃশ্য থেকে ফরাসীদের বিদায় করার জন্য। বাংলার প্রেক্ষিত নয় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সামনে এনে ইঙ্গ ফরাসী যুদ্ধের দোহাই পেড়ে ইংরেজরা ১৪ মার্চ ফরাসী অধ্যুষিত চন্দন নগর অবরোধ করে।
(১৭৫৭
চন্দন নগর অবরোধের সংবাদ পেয়ে নবাব দুর্লভরাম ও নন্দকুমারকে আবার ফরাসীদের সাহায্যের জন্য পাঠান। ইংরেজদের দেয়া ঘুষে এবারও তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ২৩ মার্চ চন্দন নগরের পতন ঘটে। ফরাসীরা বাংলায় তাদের সবগুলো কুঠি ইংরেজদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তাদের কিছু সৈন্য কাশিম বাজারে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে, কিছু প্রাণ দেয়, কিছু বন্দী হয়। ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধ করে নিহত দেশীয় সিপাহীদের ইংরেজ সেবার নিদর্শন স্বরূপ জনপ্রতি দশ টাকা করে পুরস্কার দেয়া হয়।
ডক্টর মোহর আলী লিখেছেন- ‘ইংরেজদের চন্দন নগর আক্রমণের প্রাক্কালে নবাব তাদের প্রতিরোধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু বিপুল পরিমাণ ঘুষের বিনিময়ে প্রতিরোধ বাহিনীর নেতা নন্দকুমার বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং রায় দুর্লভ রাম ইংরেজদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণে সিরাজকে বাধা দিতে থাকেন। ক্ষমতা লাভের ছয় মাসের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল পরিপক্ক হয়ে ওঠে। এই লোকগুলোর সহযোগিতায় ক্লাইভ খুব সহজেই নবাব প্রশাসনকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিকল করে ফেলেন এবং নবাবের গোপন কাগজ ও চিঠিপত্র হস্তগত করেন। নবাব এসব ষড়যন্ত্রের সবকিছু জানতে পারেন। কিন্তু ব্যাপক বিস্তৃত এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তখন তাঁর কিছুই করার ছিলো না। কারণ, তিনি কাউকেই বিশ্বাসযোগ্য বিবেচনা করতে পারেননি।’ প্রফেসর আব্দুর রহিম লিখেছেন, ২৩ এপ্রিল (১৭৫৭
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কোলকাতা কাউন্সিল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসন চ্যুত করার জন্য একটি প্রস্তাব পাস করে। হিল লিখেছেন যে, ক্লাইভ উমিচাঁদকে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করেন।’
অন্যদিকে ডক্টর মোহর আলী- ১৭৫৭ সালের পয়লা মে অনুষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম সিলেক্ট কমিটির বিবরণ দিয়ে লিখেছেন- ‘সিরাজকে উৎখাতের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের হীন পকিল্পনার পক্ষে যে সকল যুক্তি দাঁড় করায় তা হচ্ছে-
(ক
সিরাজ অসৎ এবং ইংরেজদের নির্যাতনকারী।
(খ
তিনি ফরাসীদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, যার অর্থ হচ্ছে ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ এবং
(গ
সিরাজ বাঙ্গালীদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছেন- যার ফলে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সহজেই ঘটতে পারে।
এই পরিকল্পনা গ্রহণের পর মুর্শিদাবাদের অদূরে পলাশী প্রান্তরে ক্লাইভ তাঁর সৈন্য সমাবেশ শুরু করেন। মীর জাফর ও দুর্লভ রামের নেতৃত্বে নবাব ১৫,০০০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরণ করেন। এদিকে মুর্শিদাবাদের ইংরেজ প্রতিনিধি ওয়াটস তখনই যুদ্ধ না বাঁধিয়ে সৈন্য প্রত্যাহার করে কলকাতায় সুযোগের প্রতীক্ষা করতে ক্লাইভকে উপদেশ দেন। ক্লাইভ তা মেনে নেন এবং নবাবকেও তাঁর সৈন্য প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। ইংরেজদের আচরণ নবাবের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে; তিনি তাঁর বাহিনী অপসারণের নির্দেশ দিলেন। ক্লাইভ তাঁদের আচরণের সততার প্রতি নবাবের সন্দেহ দূর করার জন্য এক কুটচাল চালেন। মারাঠাদের লিখা এক চিঠি দিয়ে তিনি স্ক্রেফ্টনকে মুর্শিদাবাদ পাঠান। এ চিঠিতে ইংরেজ ও মারাঠাদের মধ্যে বাংলাকে ভাগ করে নেবার প্রস্তাব ছিল। এবার নবাব ইংরেজদের বিশ্বাস করলেন এবং তার বাহিনীকে মুর্শিদাবাদ ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন।
‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাঁহার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা জানিতে পারেন। তিনি মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতির পদ হইতে অপসারিত করেন এবং আবদুল হাদী খানকে সে পদে নিয়োগ করেন। আবদুল হাদী ও মীর মদন মীর জাফরকে ধ্বংস করিবার জন্য নবাবকে পরামর্শ দেন। কিন্তু জগৎশেঠ ও অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক উপদেষ্টাগণ নবাবকে পরামর্শ দেন যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তিবৃদ্ধির জন্য মীর জাফরের সহযোগিতা লাভ করা নবাবের পক্ষে সুবিবেচনার কাজ হইবে। নবাব তাহাদের উপদেশ গ্রহণ করেন। তিনি মীর জাফরের বাড়ীতে গিয়ে নবাব আলীবর্দীর নামে তাঁহার নিকট ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য মর্মস্পশী আবেদন জানান। পবিত্র কুরআন হাতে লইয়া মীর জাফর এই সময় অঙ্গীকার করেন যে, তিনি নবাবের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবেন। (প্রফেসর আব্দুর রহিম
সাময়িক পদচ্যুতির অপমানে মীর জাফর দারুণভাবে প্রতিহিংসা পরায়ণ ও ক্রোধান্ধ হয়ে উঠলেন। সিরাজের আশু পতন অনিবার্য করে তোলার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নিলেন। মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করার জন্য বার বার ক্লাইভের নিকট বার্তা প্রেরণ করে তাগাদা দিতে থাকেন। এমন মাহেন্দ্রক্ষণের প্রতীক্ষায় ছিলেন ক্লাইভ। এই সুযোগে তিনি আরো অতিরিক্ত শর্ত যুক্ত করলেন। পরিণতির কথা না ভেবেই মীর জাফর সব দাবী অকপটে মেনে নিলেন। জগৎশেঠের প্রোথিত বিষাক্ত বীজ অঙ্কুর থেকে বৃক্ষে পরিণত হল, অতঃপর মহীরুহে। ম্লেচ্ছ যবন মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে নব উত্থান সম্ভাবনায় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা উদ্বেলিত হয়ে উঠল।
‘অতঃপর ষড়যন্ত্রকারীগণ জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, মীর জাফর, রাজবল্লভ এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই বৈঠকে যোগ দেন। ইংরাজ কোম্পানীর এজেন্ট ওয়াটস মহিলাদের মত পর্দা-ঘেরা পাল্কিতে জগৎশেঠের বাড়িতে আসেন। এই বৈঠকে সিরাজউদ্দৌলাকে সরাইয়া মীর জাফরকে বাংলার মসনদে বসাইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ওয়াটস এই কাজে ইংরেজদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। ইহার পর কোম্পানীর প্রধানগণ চুক্তিপত্রের খসড়া প্রস্তুত করেন এবং ১৯মে ইহাতে দস্তখত করেন। মীর জাফরসহ ৪ জন চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্তানুযায়ী ইংরাজদের সৈন্য সাহায্যের বিনিময়ে মীর জাফর তাহাদিগকে কয়েকটি বাণিজ্য-সুবিধা দিতে স্বীকার করেন। তাহা ছাড়া তিনি ইংরেজ সৈন্যদের ব্যয়ভার বহন করিতে এবং কোম্পানীকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দুই কোটি টাকা দিতে সম্মত হন। নবাবের কোষাগার হইতে উমিচাঁদকে ২০ লক্ষ টাকা দেওয়া হইবে বলিয়া বলা হয়। উমিচাঁদকে প্রতারিত করিবার জন্য ক্লাইভ চুক্তিপত্রের দুইটি খসড়া প্রস্তুত করেন। আসল খসড়ায় উমিচাঁদকে টাকা দেয়ার শর্তের উল্লেখ করা হয় নাই। নকল খসড়ায় এই শর্তটি লিখিত হয়। ইহার দস্তখতগুলি সবই ক্লাইভ জাল করিয়াছিলেন। রায়দুর্লভকেও লুটের মালের কিয়দংশ দেওয়া হইবে বলিয়া প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। (প্রফেসর আব্দুর রহিম
৪ জুনের স্বাক্ষরিত চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপ :
“আমি আল্লাহর নামে ও আল্লাহর রাসূলের নামে প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমার জীবনকালে আমি এই চুক্তিপত্রের শর্তাবলী মানিয়া চলিব।
ধারা-১ :নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে শান্তিচুক্তির যেসব ধারায় সম্মতি দান করিয়াছি, আমি সেসব ধারা মানিয়া চলিতে সম্মত হইলাম।
ধারা-২ :ইংরেজদের দুশমন আমারও দুশমন, তাহারা ভারতবাসী হোক অথবা ইউরোপীয়।
ধারা-৩ :জাতিসমূহের স্বর্গ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় ফরাসীদের সকল সম্পত্তি এবং ফ্যাক্টরীগুলো ইংজেরদের দখলে থাকিবে এবং কখনো তাহাদিগকে (ফরাসীদেরকে
ওই তিনটি প্রদেশে আর কোন স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করিতে দিব না।
ধারা-৪ :নবাব সিরাজ কর্তৃক কলিকাতা দখল ও লুণ্ঠনের ফলে ইংরেজ কোম্পানী যেসব ক্ষতির সম্মুখীন হইয়াছে তাহার বিবেচনায় এবং তন্নিমিত্ত মোতায়েনকৃত সেনাবাহিনীর জন্য ব্যয় নির্বাহ বাবদ আমি তাহাদিগকে এক ক্রোর তঙ্কা প্রদান করিব।
ধারা-৫ :কলিকাতার ইংরেজ অধিবাসীদের মালামাল লূণ্ঠনের জন্য আমি তাহাদিগকে পঞ্চাশ লক্ষ তঙ্কা প্রদান করিতে সম্মত হইলাম।
ধারা-৬ :কলিকাতার জেন্টু (হিন্দু
, মূর (মুসলমান
এবং অন্যান্য অধিবাসীকে প্রদান করা হইবে বিশ লক্ষ তঙ্কা। (ইংরেজরা হিন্দুদেরকে জেন্টু’ এবং মুসলমানাদের ‘মূর’ ও ‘মেহোমেটান’ বলে চিহ্নিত করতো
ধারা-৭ :কলিকাতার আর্মেনীয় অধিবাসীদের মালামাল লুণ্ঠনের জন্য তাহাদিগকে প্রদান করা হইবে সাত লক্ষ তঙ্কা। ইংরেজ, জেন্টু, মূর এবং কলিকাতার অন্যান্য অধিবাসীকে প্রদেয় তঙ্কার বিতরণভার ন্যস্ত রহিল এডমিরাল ওয়াটসন, কর্নেল ক্লাইভ, রজার ড্রেক, উইলিয়াম ওয়াটস, জেমস কিলপ্যাট্রিক এবং রিচার্ড বীচার মহোদয়গণের উপর। তাঁহারা নিজেদের বিবেচনায় যাহার যেমন প্রাপ্য তাহা প্রদান করিবেন।
ধারা-৮ :কলিকাতার বর্ডার বেষ্টনকারী মারাঠা ডিচের মধ্যে পড়িয়াছে কতিপয় জমিদারের কিছু জমি; ওই জমি ছাড়াও আমি মারাঠা ডিচের বাইরে ৬০০ গজ ইংরেজ কোম্পানীকে দান করিব।
ধারা-৯ :কল্পি পর্যন্ত কলিকাতার দক্ষিণস্থ সব জমি ইংরেজ কোম্পানীর জমিদারীর অধীনে থাকিবে এবং তাহাতে অবস্থিত যাবতীয় অফিসাদি কোম্পানীর আইনগত অধিকারে থাকিব।
ধারা-১০ : আমি যখনই কোম্পানীর সাহায্য দাবি করিব, তখনই তাহাদের বাহিনীর যাবতীয় খরচ বহনে বাধ্য থাকিব।
ধারা-১১ : হুগলীর সন্নিকটে গঙ্গা নদীর নিকটে আমি কোন নতুন দুর্গ নির্মাণ করিব না।
ধারা-১২ : তিনটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হইবামাত্র আমি উপরিউক্ত সকল তঙ্কা বিশ্বস্তভাবে পরিশোধ করিব।
২৩ জুন ১৭৫৭ মীর জাফরের সাময়িক পদচ্যুতির মাত্র একমাসের ব্যবধানে সমাগত হল সিরাজের অন্তিম পর্ব। পলাশীতে সৈন্য সমাবেশ হল নবাব এবং ক্লাইভ উভয় পক্ষের। নবাবের পক্ষে সৈন্য সংখ্যা ৫০ হাজার, এর মধ্যে পদাতিক ৩৫ হাজার অশ্বারোহী ১৫ হাজার। ক্লাইভের পক্ষে ছিল মাত্র ৩ হাজার দেশী বিদেশী সম্মিলিত ভাবে।
২৩ জুনের পূর্বে বাংলার মুক্তি চুক্তি নামে ১২ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মীর জাফর ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মধ্যে, তাতে মীরজাফরের পক্ষ থেকে বলা হয় : আমি আল্লাহর নামেও আল্লাহর রাসূলের নামে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমার জীবনকালে আমি এই চুক্তিপত্র মানিয়া চলিব।
এই মুক্তির চুক্তি মীর জাফর সত্যি আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করেছিলেন। প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে তিনি রনাঙ্গনে ছবির মত দাঁড়িয়ে ছিলেন। দাঁড়িয়েছিল তার বাহিনী। তিনি প্রধান সেনাপতি হয়ে নবাবের পতন উপভোগ করলেন প্রাণভরে। মুর্শিদাবাদের পতন হল। পুনরুদ্ধারের আশায় নবাব ছুটে চললেন বিহারে তার অনুগত বাহিনীর নিকট। তার আশা পূর্ণ হলো না। পথে গ্রেপ্তার হলেন। মীরজাফর তনয় মিরন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করল। তার রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সমগ্র সুবাহ বাংলার স্বাধীনতা ১৯০ বছরের জন্য মহাকালের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। সমগ্র জাতি শৃংখলিত হল ঔপনিবেশিক অক্টোপাসে। সে ইতিহাসও অতি মর্মান্তিক। ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রের ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। সিরাজের পতনের মধ্যে তারা দেখতে পেল তাদের উত্থান সম্ভাবনা।