asad71
PROFESSIONAL
- Joined
- May 24, 2011
- Messages
- 6,863
- Reaction score
- 4
- Country
- Location
বর্তমান ট্রানজিট ব্যবস্থা দেশের জন্য সহায়ক নয়
নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট: ০৩:১১, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৬ | প্রিন্ট সংস্করণ
০ Like
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে যে কাঠামোতে ট্রানজিট সুবিধা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা অসম। বাংলাদেশের জন্য এটা সহায়ক নয় বলে মনে করছেন গবেষকেরা। এ কারণে তাঁরা মনে করেন, ট্রানজিট হতে হবে আরও ব্যাপক পরিসরে ও সমন্বিতভাবে। এমনকি ট্রানজিটের মাশুল নির্ধারণের প্রক্রিয়াটিও স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়নি বলে দাবি অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ইনস্টিটিউট ফর পলিসি, অ্যাডভোকেসি ও গভর্ন্যান্স (আইপিএজি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক দিনব্যাপী আলোচনার এক কর্ম-অধিবেশনে এমন মতামত উঠে আসে। গতকাল শনিবার ডেইলি স্টার সেন্টারে একই অধিবেশনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত তুলে ধরেন আলোচকেরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান অধিবেশনে বলেন, ‘ট্রানজিট চুক্তিটি এমন ব্যাপক পরিসরে হওয়া উচিত, যেখানে অবকাঠামো থেকে শুরু করে ট্রানজিটের মাশুল সমন্বিতভাবে নির্ধারিত হয়। ট্রানজিটের মাশুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও বেশি স্বচ্ছতা দরকার। বর্তমান কাঠামোয় কিসের ভিত্তিতে মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে আমরা সুস্পষ্টভাবে কিছু জানি না।’
এর আগে দিনব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী পর্বে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি-বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, ট্রানজিট এবং পরিবহনের ফি ও চার্জ নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রান্তিক খরচ বিবেচনায় নিয়ে যতটা সম্ভব বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় কর্ম-অধিবেশনে প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে মসিউর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, যেখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামোই গড়ে ওঠেনি, সেখানে প্রান্তিক খরচের ভিত্তিতে ট্রানজিটের মাশুল নির্ধারণের যৌক্তিকতা কতটা?
এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ট্রানজিটের প্রয়োজনে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। ট্রানজিটের মাশুল ও সারচার্জের মাধ্যমে আদায় হওয়া অর্থেই সেই অবকাঠামো তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রানজিট ও ট্রান্সপোর্টেশন প্রটোকলের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে সারচার্জ, দূষণ চার্জ, রক্ষণাবেক্ষণ চার্জসহ নানা ধরনের মাশুল রয়েছে।
নৌ প্রটোকলের আওতায় মাশুল আরোপ করে জুনে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নিয়মিত ট্রানজিট শুরু হয়। ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারতের কলকাতা থেকে একটি চালান বাংলাদেশের নৌ ও সড়কপথ ব্যবহার করে আশুগঞ্জ হয়ে আগরতলায় গেছে। ট্রানজিটের ক্ষেত্রে প্রতি টন পণ্যের জন্য মাশুল নির্ধারিত হয় ১৯২ টাকা। এর মধ্যে ১৩০ টাকা পাবে শুল্ক কর্তৃপক্ষ, ৫২ টাকা পাবে সড়ক বিভাগ এবং নৌ মন্ত্রণালয় পাবে ১০ টাকা।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে গঠিত ট্রানজিট-সংক্রান্ত মূল (কোর) কমিটি নৌপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে টনপ্রতি ১ হাজার ৫৮ টাকা মাশুল আদায়ের প্রস্তাব করেছিল। ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে গঠিত ওই কোর কমিটির একজন সদস্য ছিলেন সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান। শেষ পর্যন্ত যে মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কোর কমিটির প্রস্তাবিত মাশুলের চেয়ে পাঁচ গুণেরও কম।
এ মাশুল নির্ধারণ নিয়েই প্রশ্ন তোলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কীভাবে, কিসের ভিত্তিতে এবং কারা ট্রানজিটের মাশুল নির্ধারণ করেছেন, কেউই তা জানি না। অথচ এ ক্ষেত্রে অধিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
উদ্বোধনী পর্বে মসিউর রহমান বলেন, শিলিগুড়ি থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন খরচের চেয়ে যদি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহন খরচ বেশি হয়, তাহলে ভারত শিলিগুড়ি করিডর ব্যবহারে বেশি আগ্রহী হবে। এমনটিই ঘটেছিল খাদ্যশস্য পরিবহনের ক্ষেত্রে। এর ফলে দেড় বছর কোনো ধরনের পণ্য পরিবহন বন্ধ ছিল। পরে চার্জ কমানোর ফলে আবারও ট্রানজিটের আওতায় পণ্য পরিবহন শুরু হয়।
ট্রানজিটের ক্ষেত্রে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার সমন্বয়হীনতাকে বড় সমস্যা বলে মত দেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘ট্রানজিটের মূল দায়িত্বের সঙ্গে তিন থেকে চারটি বিভাগ জড়িত। কিন্তু এসব বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের কার্যকর কোনো কৌশল এখন পর্যন্ত আমাদের নেই।’
দিনব্যাপী আলোচনায় দ্বিতীয় কর্ম-অধিবেশনের বিষয়বস্তু ছিল ‘অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংযোগ ও জ্বালানি সম্পর্ক’। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত কর্ম-অধিবেশনে প্যানেল আলোচক ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রজিত মিত্তার, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির (সিআইআই) সদস্য পঙ্কজ ট্যান্ডন, বাংলাদেশি শিল্পগ্রুপ এসিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ দৌলা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ সহকারী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম এবং ভারতের দ্য এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের ফেলো নিত্যানন্দ।
রজিত মিত্তার বলেন, দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে যৌথ বিনিয়োগকে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত যে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে, সেটি কাজে লাগিয়ে রপ্তানি বাড়াতে হলে রপ্তানিপণ্যের বহুমুখীকরণে বিশেষ নজর দিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশি পণ্য ভারতের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব অশুল্ক বাধা রয়েছে, ভারতের দিক থেকে সেসব বাধা তুলে নিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরি। দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে দরকার দুই দেশের মধ্যে নিবিড় সমন্বয়।
এসিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পণ্যের মান। এ মান যাচাইয়ে দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় মান যাচাইকারী পরীক্ষাগার স্থাপন জরুরি। কিন্তু সেটি না থাকায় মান যাচাইয়ের পেছনে যে সময় ব্যয় হয়, তাতে খরচ বেড়ে যায়। এ সময় তিনি বলেন, ভারতের তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসিআইয়ের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিতর্ক: রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতার পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম। তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে যদি ভারতের পরিবর্তে মালয়েশিয়া জড়িত থাকত, তাহলে এত বিরোধিতা হতো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আবার রামপালের পরিবর্তে যদি ভারতের সহায়তায় চট্টগ্রামের আনোয়ারাতেও এ প্রকল্প হতো, সে ক্ষেত্রেও বিরোধিতা হতো। রামপাল বিরোধিতার সঙ্গে মূলত পরিবেশগত ঝুঁকি ও ভারতবিরোধী রাজনীতি জড়িত।
ম তামিমের বক্তব্যের বিরোধিতা করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা ভারত বিরোধিতার জন্য নয়, পরিবেশগত ঝুঁকির জন্য। কারণ, রামপালের কাছেই সুন্দরবনের অবস্থান। এ জন্যই জনগণ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করছে। একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের মাধ্যমে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির ঝুঁকি নিরূপণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঝুঁকি বিষয়ে ভারতীয় গবেষক নিত্যানন্দ বলেন, সাধারণত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১০ কিলোমিটারের বাইরে তেমন একটা পরিবেশগত ঝুঁকি থাকে না। সেখানে রামপাল থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। তাই রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলেও তাতে সুন্দরবনের খুব বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
রামপাল প্রসঙ্গে মসিউর রহমান বলেন, যাঁরা এ প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা তাঁদের অবস্থানের পক্ষে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকলে তা প্রকাশ করুন। সরকার অবশ্যই তা বিবেচনায় নেবে।
রামপাল প্রসঙ্গে ভারতের সিআইআইয়ের সদস্য পঙ্কজ ট্যান্ডন বলেন, একটি নিরপেক্ষ কমিশন বা কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিবেশগত ঝুঁকির দিকটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তবে এটি কিছুটা সময়সাপেক্ষও বটে।
অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, তা অনুন্নত প্রযুক্তির। এ ছাড়া রামপাল বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো অনেক বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা হচ্ছে না।
বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও জ্বালানি সম্পর্কের বিষয়ে প্যানেল আলোচকদের আলোচনায় যেসব পরামর্শ উঠে আসে, তার মধ্যে রয়েছে দুই দেশের স্থলবন্দরগুলোর মান উন্নত করা, ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব অশুল্ক বাধা রয়েছে, সেগুলো দূর করা। পাশাপাশি দুই দেশের সংযোগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।
নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট: ০৩:১১, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৬ | প্রিন্ট সংস্করণ
০ Like
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ইনস্টিটিউট ফর পলিসি, অ্যাডভোকেসি ও গভর্ন্যান্স (আইপিএজি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক দিনব্যাপী আলোচনার এক কর্ম-অধিবেশনে এমন মতামত উঠে আসে। গতকাল শনিবার ডেইলি স্টার সেন্টারে একই অধিবেশনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত তুলে ধরেন আলোচকেরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান অধিবেশনে বলেন, ‘ট্রানজিট চুক্তিটি এমন ব্যাপক পরিসরে হওয়া উচিত, যেখানে অবকাঠামো থেকে শুরু করে ট্রানজিটের মাশুল সমন্বিতভাবে নির্ধারিত হয়। ট্রানজিটের মাশুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও বেশি স্বচ্ছতা দরকার। বর্তমান কাঠামোয় কিসের ভিত্তিতে মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে আমরা সুস্পষ্টভাবে কিছু জানি না।’
এর আগে দিনব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী পর্বে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি-বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, ট্রানজিট এবং পরিবহনের ফি ও চার্জ নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রান্তিক খরচ বিবেচনায় নিয়ে যতটা সম্ভব বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় কর্ম-অধিবেশনে প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে মসিউর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, যেখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামোই গড়ে ওঠেনি, সেখানে প্রান্তিক খরচের ভিত্তিতে ট্রানজিটের মাশুল নির্ধারণের যৌক্তিকতা কতটা?
এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ট্রানজিটের প্রয়োজনে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। ট্রানজিটের মাশুল ও সারচার্জের মাধ্যমে আদায় হওয়া অর্থেই সেই অবকাঠামো তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রানজিট ও ট্রান্সপোর্টেশন প্রটোকলের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে সারচার্জ, দূষণ চার্জ, রক্ষণাবেক্ষণ চার্জসহ নানা ধরনের মাশুল রয়েছে।
নৌ প্রটোকলের আওতায় মাশুল আরোপ করে জুনে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নিয়মিত ট্রানজিট শুরু হয়। ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারতের কলকাতা থেকে একটি চালান বাংলাদেশের নৌ ও সড়কপথ ব্যবহার করে আশুগঞ্জ হয়ে আগরতলায় গেছে। ট্রানজিটের ক্ষেত্রে প্রতি টন পণ্যের জন্য মাশুল নির্ধারিত হয় ১৯২ টাকা। এর মধ্যে ১৩০ টাকা পাবে শুল্ক কর্তৃপক্ষ, ৫২ টাকা পাবে সড়ক বিভাগ এবং নৌ মন্ত্রণালয় পাবে ১০ টাকা।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে গঠিত ট্রানজিট-সংক্রান্ত মূল (কোর) কমিটি নৌপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে টনপ্রতি ১ হাজার ৫৮ টাকা মাশুল আদায়ের প্রস্তাব করেছিল। ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে গঠিত ওই কোর কমিটির একজন সদস্য ছিলেন সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান। শেষ পর্যন্ত যে মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কোর কমিটির প্রস্তাবিত মাশুলের চেয়ে পাঁচ গুণেরও কম।
এ মাশুল নির্ধারণ নিয়েই প্রশ্ন তোলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কীভাবে, কিসের ভিত্তিতে এবং কারা ট্রানজিটের মাশুল নির্ধারণ করেছেন, কেউই তা জানি না। অথচ এ ক্ষেত্রে অধিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
উদ্বোধনী পর্বে মসিউর রহমান বলেন, শিলিগুড়ি থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন খরচের চেয়ে যদি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহন খরচ বেশি হয়, তাহলে ভারত শিলিগুড়ি করিডর ব্যবহারে বেশি আগ্রহী হবে। এমনটিই ঘটেছিল খাদ্যশস্য পরিবহনের ক্ষেত্রে। এর ফলে দেড় বছর কোনো ধরনের পণ্য পরিবহন বন্ধ ছিল। পরে চার্জ কমানোর ফলে আবারও ট্রানজিটের আওতায় পণ্য পরিবহন শুরু হয়।
ট্রানজিটের ক্ষেত্রে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার সমন্বয়হীনতাকে বড় সমস্যা বলে মত দেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘ট্রানজিটের মূল দায়িত্বের সঙ্গে তিন থেকে চারটি বিভাগ জড়িত। কিন্তু এসব বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের কার্যকর কোনো কৌশল এখন পর্যন্ত আমাদের নেই।’
দিনব্যাপী আলোচনায় দ্বিতীয় কর্ম-অধিবেশনের বিষয়বস্তু ছিল ‘অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংযোগ ও জ্বালানি সম্পর্ক’। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত কর্ম-অধিবেশনে প্যানেল আলোচক ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রজিত মিত্তার, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির (সিআইআই) সদস্য পঙ্কজ ট্যান্ডন, বাংলাদেশি শিল্পগ্রুপ এসিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ দৌলা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ সহকারী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম এবং ভারতের দ্য এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের ফেলো নিত্যানন্দ।
রজিত মিত্তার বলেন, দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে যৌথ বিনিয়োগকে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত যে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে, সেটি কাজে লাগিয়ে রপ্তানি বাড়াতে হলে রপ্তানিপণ্যের বহুমুখীকরণে বিশেষ নজর দিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশি পণ্য ভারতের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব অশুল্ক বাধা রয়েছে, ভারতের দিক থেকে সেসব বাধা তুলে নিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরি। দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে দরকার দুই দেশের মধ্যে নিবিড় সমন্বয়।
এসিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পণ্যের মান। এ মান যাচাইয়ে দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় মান যাচাইকারী পরীক্ষাগার স্থাপন জরুরি। কিন্তু সেটি না থাকায় মান যাচাইয়ের পেছনে যে সময় ব্যয় হয়, তাতে খরচ বেড়ে যায়। এ সময় তিনি বলেন, ভারতের তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসিআইয়ের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিতর্ক: রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতার পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম। তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে যদি ভারতের পরিবর্তে মালয়েশিয়া জড়িত থাকত, তাহলে এত বিরোধিতা হতো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আবার রামপালের পরিবর্তে যদি ভারতের সহায়তায় চট্টগ্রামের আনোয়ারাতেও এ প্রকল্প হতো, সে ক্ষেত্রেও বিরোধিতা হতো। রামপাল বিরোধিতার সঙ্গে মূলত পরিবেশগত ঝুঁকি ও ভারতবিরোধী রাজনীতি জড়িত।
ম তামিমের বক্তব্যের বিরোধিতা করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা ভারত বিরোধিতার জন্য নয়, পরিবেশগত ঝুঁকির জন্য। কারণ, রামপালের কাছেই সুন্দরবনের অবস্থান। এ জন্যই জনগণ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করছে। একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের মাধ্যমে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির ঝুঁকি নিরূপণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঝুঁকি বিষয়ে ভারতীয় গবেষক নিত্যানন্দ বলেন, সাধারণত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১০ কিলোমিটারের বাইরে তেমন একটা পরিবেশগত ঝুঁকি থাকে না। সেখানে রামপাল থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। তাই রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলেও তাতে সুন্দরবনের খুব বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
রামপাল প্রসঙ্গে মসিউর রহমান বলেন, যাঁরা এ প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা তাঁদের অবস্থানের পক্ষে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকলে তা প্রকাশ করুন। সরকার অবশ্যই তা বিবেচনায় নেবে।
রামপাল প্রসঙ্গে ভারতের সিআইআইয়ের সদস্য পঙ্কজ ট্যান্ডন বলেন, একটি নিরপেক্ষ কমিশন বা কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিবেশগত ঝুঁকির দিকটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তবে এটি কিছুটা সময়সাপেক্ষও বটে।
অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, তা অনুন্নত প্রযুক্তির। এ ছাড়া রামপাল বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো অনেক বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা হচ্ছে না।
বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও জ্বালানি সম্পর্কের বিষয়ে প্যানেল আলোচকদের আলোচনায় যেসব পরামর্শ উঠে আসে, তার মধ্যে রয়েছে দুই দেশের স্থলবন্দরগুলোর মান উন্নত করা, ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব অশুল্ক বাধা রয়েছে, সেগুলো দূর করা। পাশাপাশি দুই দেশের সংযোগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।