Skallagrim
FULL MEMBER
- Joined
- Feb 21, 2012
- Messages
- 1,837
- Reaction score
- 0
খালেদার জয়-পরাজয়
ফরহাদ মজহার
২২ জানুয়ারি ২০১৪, বুধবার, ৯:২৯
এক.
আগের লেখায় আন্দোলনের ধরন নিয়ে আলোচনা করেছি (দেখুন, ‘হাসিনার নয় দফা ও আন্দোলনের ধরন’Ñ নয়া দিগন্ত, ১৯ জানুয়ারি ২০১৪)। সেই প্রসঙ্গে ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পন্ন হবার পর তখনকার বর্জনের নেত্রী শেখ হাসিনার বিখ্যাত ‘নয় দফা’র কথাও সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছি। বেগম খালেদা জিয়া ১৫ জানুয়ারিতে যে কর্মসূচি ও বক্তব্য দিয়েছেন তার সঙ্গে শেখ হাসিনার নয় দফা তুলনা করলে মনে হয় বিএনপি আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট অর্জন সম্পর্কে অস্পষ্ট। অন্য দিকে গণমাধ্যমের প্রপাগান্ডায় আন্দোলনের ধরন নিয়ে উৎকণ্ঠিত।
বিএনপি আইন মেনে চলা ভোটাভুটির দল। উদার ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যেই তাকে থাকতে হবে। তাই এই উৎকণ্ঠা স্বাভাবিক। কিন্তু উৎকণ্ঠাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিএনপি অতীতে বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনে যেভাবে সন্ত্রাস ও সহিংসতা ঘটেছে, তার ইতিহাস মনে রাখেনি। অস্বীকার করবার উপায় নাই যে স্বাধীনতার পর অতীতের যেকোন আন্দোলনের চেয়ে এবারের আন্দোলন ছিল ব্যাপক ও জনগণের অংশগ্রহণও ছিল বিপুল। ঢাকা অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঘটনা এর আগে একাত্তরের পর দেখা যায়নি। আন্দোলনের দিক থেকে এটা ছিল সুস্পষ্ট বিজয়; জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের এই শক্তিকে খালেদা জিয়া কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছেন, বলা মুশকিল। কারণ ২৯ ডিসেম্বরের শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রের অভিযাত্রা সরকারের মারমুখী সহিংসতার কারণে সফল করা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের মাত্রা অতীতের যেকোন আন্দোলনের তুলনায় সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাস্তায় নামার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবার নজির অবিশ্বাস্য। আন্দোলনের বিস্তার ও বিপুল অংশগ্রহণের ফলে সহিংসতা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি দৃশ্যমান ছিল।
তবে জনগণের প্রতিরোধের রূপ বা ধরনের দিক থেকে, এবারও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মোকাবিলা অতীতের গণ-আন্দোলনের ধরন কিম্বা মাত্রা অতিক্রম করেনি। এই দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে কেউ গ্রেনেড বা স্বয়ংক্রিয় কোন অস্ত্র নিয়ে নেমে পড়েছে, এমন কোন নজির বা অভিযোগের কথা জানা যায় নাই। গানপাউডার দিয়ে বাস ও বাসের আরোহীদের পুড়িয়ে মারা, মলটভ ককটেল (১৮ দল ছুড়লে যার নাম বদলে গিয়ে হয় ‘পেট্রল বোমা’) মেরে যানবাহন আগুনে ছাই করে দেয়া, রেলস্টেশন পুড়িয়ে ফেলা, রেললাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলাÑ ইত্যাদি সকল প্রকার ‘তাণ্ডব ও সন্ত্রাস’ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দেখিয়েছেন এবং শিখিয়েছেন, তার খালেদা জিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলনে দুই পর্বে। এটাই এ দেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ বা ফর্ম হিসেবে আন্দোলনের ধরন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার বিরোধী দল বারবার অনেক ঘটনাকে সরকার পরেই করা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ বলে নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছে, এ েেত্র তাদের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন সুষ্ঠু ও নিরপে তদন্ত হয়নি। সরকারপীয় গণমাধ্যমগুলোর একপীয় মিথ্যাচারে সত্য আড়াল হয়ে গিয়েছে।
ুব্ধ হয়ে বাসে আগুন দেয়া এক জিনিস আর গানপাউডার সাথে বয়ে নিয়ে বাসে আগুন দেয়া চরিত্রের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধরন। এমনকি যাত্রীদের নামার সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়নি। যানবাহনে অগ্নিসংযোগের েেত্র এই দুই ধরনের রূপ আরো ঘনিষ্ঠ পর্যালোচনার দাবি রাখে। মানুষকে বাস থেকে বের হতে না দিয়ে গানপাউডার দিয়ে আগুন লাগানো এবং পুড়ে যাওয়া অসহায় মানুষগুলোকে বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা ও ক্রমাগত জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-বিােভের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রচারের কাজে ব্যবহারের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। এর কোন জবাব এখনো মেলেনি। এভাবে পুড়িয়ে মারা ও বার্ন ইউনিটে তা প্রদর্শনের প্রপাগান্ডা কৌশল মতাসীনদের দমনমূলক রাজনীতিকেই মদদ জোগায়। অপকর্মটি বিরোধী রাজনীতির কাণ্ড কি না সন্দেহ সৃষ্টি করে। ফলে এর নিরপে ও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া খুবই জরুরি।
সরকারি সশস্ত্রতার বিরুদ্ধে অনন্যোপায় হয়ে পাল্টা ভয় দেখানোর শব্দ তৈরি করা বা ঘরে বোমা তৈরি করে ভীতিকর ধোঁয়া সৃষ্টি করার ‘আরবান টেররাইজেশন’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারে গণ-আন্দোলনের সীমার মধ্যকার তৎপরতা বলেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। একেও অনেকে নিন্দা করতে পারেন, ঠিক আছে। কিন্তু এর কারণে গণবিােভের ন্যায্যতাকে নাকচ করে দেবার রাজনীতি সমর্থনের সুযোগ নাই। সেটা হয়ে দাঁড়ায় মতাসীনদের রাজনীতি ও তাদের প্রপাগান্ডার অস্ত্র। অথচ তারা নিজেরা এর চেয়েও অনেক বেশি সন্ত্রাস ও সহিংসতা করেই আজ মতায় বসে আছেন। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যাকাণ্ডের কথা না-ই বা তুললাম!
আন্দোলন-সংগ্রামে ুব্ধ ও সীমিত সহিংস চরিত্র থাকা, আর মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া এক কথা নয়। গানপাউডার ব্যবহার আর সর্বোপরি যাত্রীদের নেমে যাবার সময় ও সুযোগ না দিয়ে আগুনে পোড়ানো সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া সহিংসতা। কারা তা করেছে তা খুঁজে বের করা ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান নাভি পিল্লাইও তার হুঁশিয়ারিমূলক বিবৃতিতে, ‘আরোহী যাত্রীদের নামার সময় ও সুযোগ না দিয়ে’ যানবাহনে আগুন দেবার কথা স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছিলেন। প্রাণহানিতে নিহত মানুষ ফিরিয়ে আনা যায় না, অন্য সব তি হয়তো পূরণীয়। ফলে এ কাজ নিন্দনীয় এবং আন্দোলনের এই আওয়ামী ধরনকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কিন্তু পটকা বা ঘরে তৈরী বোমা এর আগেও ব্যবহার করা হয়। এবারও হয়েছে।
যেটা নতুন সেটা হচ্ছে রাস্তায় মিছিল নিয়ে নামা মাত্রই পুলিশের গুলি চালানো। বুক ও মাথা ল্য করে হত্যার জন্য গুলি ছোড়া এর আগে ছিল না। নতুন প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রত্য অংশগ্রহণকারীদের থেকে শোনা, তারা বলছেন দশজনেরও একটা মিছিল নিয়ে যদি রাস্তায় নামতে চাই আর সাথে যদি দুইটা ককটেলও না থাকে তবে পুলিশের গুলি খেয়ে মরতে হবে। কারণ পুলিশ আমাদের দেখে ফেললে তাদের ভয় দেখানোর জন্য আমাদের কয়েক সেকেন্ড সময় দরকার, যাতে দ্রুত নিরাপদ একটা অবস্থানে সরে গিয়ে আশ্রয় জুটিয়ে নিতে পারি। এ কাজে ককটেলের ভয় দেখানো ধোঁয়া আর শব্দ একটু কাজের হয়, কিছুটা সময় দেয়। বেশ কিছু জায়গায়, বিশেষত রাজশাহী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় দেখা গিয়েছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে সাধারণ পোশাকে কিছু ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিােভকারীদের ওপর হামলা করছে। রাষ্ট্র বা সরকারি বাহিনীর সন্ত্রাস ও তার সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদেরই আশ্রয়ে মতাসীনদের দলীয় সহিংসতার এই ধরনগুলো অতীতে মুজিব আমলেও দেখা যেত। বলা বাহুল্য গণমাধ্যমগুলোর বেশির ভাগই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কিভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধকেই তাদের প্রপাগান্ডার কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত করেছে। এই সময় কতজন মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি এবং নির্যাতনে নিহত হয়েছেন এবং বিপরীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধে কী পরিমাণ প্রাণহানি ঘটেছেÑ এই দুই পরিসংখ্যানের মধ্যকার ফারাক বিস্ময়কর। বাংলাদেশের বেয়াল্লিশ বছরের ইতিহাসে এত বড় হত্যাযজ্ঞ এর মাঝে ঘটেনি।
তবুও বলা দরকার যারা রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা চান না, তাদের সংবেদনার সঙ্গে আমরা একদমই একমত। কিন্তু সেটা বন্ধ করতে হলে প্রথমে নজর দিতে হবে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ওপর। নাগরিকরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র ও সমাজ তৎণাৎ ভেঙে পড়ে না। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার যখন সংবিধান, আইন, মানবাধিকার কিম্বা নীতিনৈতিকতা, নাগরিক ও মানবিক অধিকার কিছুই মানে না, নিজেই নিজের নাগরিকদের বিচার ছাড়া হত্যা করে, তখন রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা ভেঙে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তখন সন্ত্রাস ও সহিংসতা যে উচ্চ মাত্রায় পৌঁছায় তা অভীষ্ট ল্েয পৌঁছানো ছাড়া তুরীয় উত্তাপ থেকে নেমে আসা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা কমিয়ে আনা দ্বিতীয়ত নির্ভর করে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের ভূমিকার ওপর। যদি সরকারের নীতি হয় দিল্লির আত্মঘাতী রণনীতি বাস্তবায়নÑ অর্থাৎ যেভাবেই হোক বাংলাদেশ থেকে ইসলামপন্থীদের শারীরিক অর্থে নির্মূল, তাহলে আন্দোলনকে সহিংস করবার দায়দায়িত্ব ষোল আনা মতাসীনদের। অথচ আইনের শাসন ও শক্তিশালী নিরপে বিচারব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতিচর্চার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা কমিয়ে আনার কার্যকর শর্ত তৈরি করা সম্ভব।
এমনিতেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরায় রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল বা গ্রুপ এবং সব নাগরিককে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাখার রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝার সামর্থ্য আমাদের নাই বললেই চলে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি তখনই সম্ভব যখন নাগরিক অধিকারের সীমার মধ্যে সব ধরনের রাজনীতি ও মতাদর্শ চর্চা করার সুযোগ অবাধ থাকে। এই মৌলিক সূত্রের দিকে নজর ফেরানোর মতো রাজনৈতিক দিশা সমাজে ও সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত। বিএনপিও এসব দিকে খোঁজখবর রাখে বলে মনে হয় না, তাদের আগ্রহও দেখা যায় না। অথচ এটাই হতে পারত জনগণকে বিভক্ত নয়, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করার মূলনীতি।
হাসিনার নয় দফার সঙ্গে তুলনা করলে আমরা দেখব গণ-আন্দোলনের কৌশল সম্পর্কে বিএনপি যারপনাই অস্পষ্ট, এখন অবধি আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে তারা গভীরভাবে ভাবেনি। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার েেত্র নীতি ও কৌশল নির্ণয় করবার দুর্বলতাগুলো তাদের মধ্যে প্রকট। এটা এখন বেশি ধরা পড়ছে কারণ বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন অতীতের যেকোন আন্দোলনের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের ভবিষ্যৎ নির্ণয়ের েেত্র নির্ধারক হয়ে উঠেছে। বিএনপির নেতারা খেয়াল করলে দেখতেন, শেখ হাসিনা কিভাবে আন্দোলন করতে চাইছেন। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বিরাট কোন থিসিস হাজির করেননি। যে বক্তব্য নির্বাচনী ইশতেহারে থাকার কথা সে বক্তব্য আন্দোলনের মাঝখানে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনে দেওয়াটাও দুর্বল সিদ্ধান্ত ছিল। এই মুহূর্তে সেটা ছিল বেদরকারি। মনে হয়েছে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কাটপেস্ট করে বেখাপ্পাভাবে বেগম জিয়ার বক্তব্যের মাঝখানে কিছু বক্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা গত আন্দোলনে সরকার উৎখাতের কথাই বলেছিলেন, যে সরকারকে ‘অবৈধ’ বলেছেন, তাদের সঙ্গে সমঝোতার কথা বলেননি। সংবিধান ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কিভাবে ‘অবৈধ’ সরকার উৎখাত করতে হবে তার ফর্মুলাই তিনি হাজির করেছিলেন। সংবিধানের মধ্যে থেকেও কিভাবে মতাসীন সরকারকে উৎখাত করা যায় সে কথাই নয়টি দাবির মধ্য দিয়ে পেশ করেছেন। যে কারণে গত লেখা আমি নয় দফার ওপর লিখেছি।
খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারকে অবৈধ বলছেন, তাহলে নিয়মতান্ত্রিক দল হিসেবে আইন ও সংবিধানের মধ্যে থেকে এই ধরনের সরকারকে উৎখাতের ফর্মুলাই জনগণ তাঁর কাছে চেয়েছে। শিখতে হবে, খালেদার বিরুদ্ধে যখন সহিংস আন্দোলন করছিলেন তখন ‘অবৈধ’ সরকারের সাথে সমঝোতা বা সংলাপ করতে হাসিনা চাননি, আহবানও জানাননি।
দুই.
হাউজ অব কমন্স ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্কের সারকথা হচ্ছে জবরদস্তি ঢাকায় যারা মতায় রয়েছে তাদের ওপর দ্রুত নির্বাচন করবার জন্য মৃদু চাপ সৃষ্টি। ধারণা করা যায়, যে চাপই আসুক কাজ হবে না। শেখ হাসিনা খানিক বিরক্ত হবেন হয়তো, যথারীতি তিনি তা এড়িয়ে চলবেন। দণি এশিয়ার জন্য নির্ধারিত দিল্লির রণনীতিটাই তিনি অনুসরণ করবেন। তাঁর গণবিচ্ছিন্নতা বিবেচনায় রেখে নির্মোহভাবে বিচার করলে এই নীতি অনুসরণই তাঁর দিক থেকে সঠিক। তার সামনে আর কোন পথ খোলা নাই। এর সঙ্গে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিশেষত দণি-পূর্ব ভারতের প্রশ্ন জড়িত। বাংলাদেশে যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি করবার মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যা সমাধানের নীতি দিল্লির চোখ দিয়ে দেখতে হবে। দেখলে দিল্লির রণনীতি ও শেখ হসিনার রণরঙ্গিনী মূর্তি মোটেও ভুল বা মন্দ বলা যাবে না। অর্থাৎ দিল্লীর স্বার্থের দিক থেকে তাকালে এটাই উভয়ের জন্য সবচেয়ে লাভজনক নীতি। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বিদ্রোহ সমূলে উৎখাত করতে চাইলে দিল্লির কাছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে ভাল সুযোগ ভবিষ্যতে দিল্লির জন্য আসবে কি না সন্দেহ। অতএব শেখ হাসিনাকে নিঃশর্তভাবে সমর্থনই দিল্লি ঠিক মনে করছে। সম্ভবত এই ধরনের নির্বাচনই দিল্লি চেয়েছে। হাসিনার বিপে বাংলাদেশের জনগণের ভোট দেওয়া ও তাকে মতা থেকে সরিয়ে দেবার প্রক্রিয়াটাই দিল্লি রুখতে চেয়েছে। এখন অবধি দিল্লি ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ অর্থাৎ ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’দের দমন করা দুই দেশের নিরাপত্তার জন্য দরকারি বলে জনমত গড়তে পারছে। এটা ছল হলেও দিল্লি এখনো এতে সফল। সফলতার অর্থ হচ্ছে ভারতীয়দের এই প্রচারণায় বোঝানো যাচ্ছে, শেখ হাসিনাকে মতায় রেখে ইসলামপন্থীদের দমন করা না গেলে বাংলাদেশে আবার উত্তর-পূর্ব ভারত ও কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ক্যাম্প গাড়বে এবং সীমান্তের ওপার থেকে ভারতের অভ্যন্তরে সহিংস কার্যকলাপ চালিয়ে যাবে। অতএব দিল্লি-ঢাকা যৌথ অভিযানের এই রণনীতি ভারতের নিরাপত্তার জন্যই জরুরি। ঘন ঘন বাংলাদেশের অমুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন নিজে সৃষ্টি করে হলেও হিন্দু সম্প্রদায়কে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িক ও হিন্দুবিদ্বেষী মুসলমানদের হাত থেকে রা করার জন্য এই নীতিটা চালিয়ে যাওয়া দরকার।
অন্য দিকে দিল্লির ধারণা, বাংলাদেশের জনগণকেও বোঝানো যাচ্ছে এটা একাত্তর সালের মতো স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরে শক্তির রণধ্বনিও অভিন্ন। দিল্লির এই রণনীতির পে বাংলাদেশে শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম রয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশপন্থী গণমাধ্যম নাই বললেই চলে। সর্বশেষ দৈনিক ইনকিলাবও সিলগালা হয়ে গেল, তার প্রকাশনা আটকে দেয়া হয়েছে।
শাহবাগের আন্দোলন দিল্লির রণনীতির পে শক্তিশালী যুক্তি। শাহবাগের বিশাল ‘গণজাগরণ’ এটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের জনগণ জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও নানান কিসিমের ইসলামি দলের হাত থেকে নিষ্কৃতি চায়। দিল্লি যুক্তি দিচ্ছে, এই ‘অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপে’ শক্তিকে ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে কাজে লাগানো উচিত। অতএব একাত্তর সালে ভারতীয় সৈন্যসহ দিল্লি যেভাবে বাংলাদেশকে সরাসরি যুদ্ধে সমর্থন করেছিল সেই একইভাবে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করে ইসলামপন্থীদের এখনই ‘নির্মূল’ করতে হবে। আফটার অল, এটা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংলাপ তখনই করা হবে যখন তিনি জামায়াত ও হেফাজতকে ত্যাগ করে আসেন। তিনি যদি না আসেন তাহলে বিএনপির মধ্যে জামায়াতবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের পরে নেতা ও কর্মীদের বড় একটি অংশই তাঁকে ত্যাগ করে নতুন দল গঠন করবে এবং দিল্লির রণনীতি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। এ প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক টাইমসের দ্বিতীয় রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে উদ্ধৃত করে লেখায় তার মন্তব্য পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। বাংলাদেশের একাত্তরের অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে দিল্লি ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সকল প্রকার বিদ্রোহের সমুচিত জবাব দিতে চায়।
এটা ভাববার কোনই কারণ নাই যাঁরা শাহবাগে অংশগ্রহণ করেছেন এবং যারা একে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গণ্য করেন তাদের সবার সঙ্গে দিল্লির এই রণনীতির আদৌ কোন সম্পর্ক রয়েছে। বরং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ শাহবাগকে সমর্থন দেওয়ায় শাহবাগের আন্দোলনের তি হয়েছে। বাংলাদেশের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যারা আন্তরিকভাবেই চেয়েছেন তাঁরা কোনভাবে দিল্লির এই রণনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত নন। বিশাল একটি অংশ শেখ হাসিনার রাজনীতিরও সমর্থক কি না সন্দেহ। আওয়ামী লীগের প্রতি পপাত রয়েছে, কিন্তু দলটির এখনকার রাজনীতির সমর্থক নন তাঁদের সংখ্যাও শাহবাগে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কম নয়। তবে ুদ্র একটি অংশ এখনো আওয়ামী রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
দিল্লির এই রণনীতির পে ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণ থাকবে এই অনুমানও ভুল। আমরা শুধু দাবি করতে চাইছি বেআইনি ও অবৈধ সরকারবিষয়ক সঙ্কট ও বর্তমান গণবিচ্ছিন্নতার কারণে শেখ হাসিনা বিপদে আছেন, দুর্বল তিনি। এই দুর্বলতার জন্য দিল্লির এই রণনৈতিক অবস্থানের ফাঁদে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে যেতে তিনি বাধ্য এবং তার পরিণতি বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের জন্য শুভ পরিণতি বয়ে আনবে না। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক দাবি করেন যে দিল্লির পররাষ্ট্রনীতি যে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় তা ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা ঠিক হয় না। বরং ঠিক হয় সাউথ ব্লকে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে; আর তা ঠিক করেন আমলারা। এটা পরিষ্কার, বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির বর্তমান নীতি বাস্তবতাবর্জিত, এই নীতির মধ্যে প্রাজ্ঞতা, বিচণতা ও দূরদৃষ্টির প্রকট অভাব রয়েছে। শেখ হাসিনার দুর্বলতার সুযোগ দিল্লি পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করছে। দিল্লির নিঃশর্ত সমর্থনের জোরে অন্যান্য দেশের প থেকে দেওয়া চাপ হাসিনা তোয়াক্কা করবেন না; এটাই বলতে চাইছি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ফরাসি, ওলন্দাজ ও জার্মানদের বর্ণবাদ ও ইসলামবিদ্বেষ অপরিচিত কিছু নয়। তারা শেখ হাসিনার ইসলাম দমনকে প্রশংসার চোখেই দেখে। দিল্লি জানে একটা পর্যায়ে ‘ইসলামি সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে দিল্লি-ঢাকা যৌথ অভিযানের প্রতি ইউরোপের সমর্থন থাকবে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তিন.
এবার ‘গুজব’। ইন্টারনেটে ওয়েবসাইট ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন আসমানি নেটওয়ার্কগুলো ‘বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি’র কথিত তথ্যে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে এবং ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই সব তথ্যকে ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে। পাশাপাশি দৈনিক ইনকিলাবের সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও প্রেস সিলগালা করে দিয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। তারা সেই কথিত তথ্যের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকারের কথাও ছেপেছিল। খবরটির শিরোনাম করেছিল, ‘সাতীরায় যৌথবাহিনীর অপারেশনে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা! : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকার’Ñ এভাবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতির খবর ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেটা অবশ্যই হতে পারে বা হয়তো আসলেই তা-ই। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়ে প্রমাণ না করে গণমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর কারণে বিষয়টির মীমাংসা হবে না। বরং আরো জটিল হবে; সন্দেহকে আরো তীব্র করবে। বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে ভারতীয় গোয়েন্দারা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের এর আগেও ধরে নিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে ভারতীয় অপারেটিভদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তৎপরতা চালানো নতুন তথ্য নয়। দ্বিতীয়ত নিজের দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ দমনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, এ েেত্র তাদের অভিজ্ঞতাও প্রচুর। এ অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে সাতীরার পরিস্থিতি দমনে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ও গণবিচ্ছিন্ন সরকার দিল্লির কাছে সামরিক সাহায্য চাইতেই পারে। দিল্লি নিজ দেশের বাইরে এই ধরনের গোপন অভিযানে অংশ নিয়েছে কি না সেটা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা ও গোপনীয়তাই এই তর্ককে বিপজ্জনক করে তুলেছে।
গুজব হোক কি সত্য হোক, আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এই খবরের রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশের জনগণ কিম্বা বাংলাদেশের সরকার এই ধরনের গুজবের প্রতি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে তার দ্বারা দিল্লির প্রতি বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সংবেদনা পরিমাপ করা যাবে। এই অঞ্চলে আগ্রহী প্রতিটি পরাশক্তি তাকে গুরুত্বের সঙ্গেই পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে দণি এশিয়ার নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র কেমন হতে পারে তা এই প্রতিক্রিয়া থেকে আন্দাজ করা যাবে অনায়াসেই। দিল্লি চাইলেও এই ‘গুজব’কে হাল্কা করতে পারবে না।
অন্য দিকে ‘সার্বভৌমত্ব’ সংক্রান্ত প্রাচীন ধারণা মাথায় রেখে শক্তিশালী দেশগুলো আজকাল আর কাজ করে না। সেটা আমরা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেÑ বিশেষত লিবিয়া, সিরিয়ায় দেখেছি। ফলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বিদেশী সৈন্য ঢুকে পড়তেই পারে। এটা অবাক হবার মতো কোন
অবাস্তব ‘গুজব’ নয়। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাই বলে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও দুর্বল দেশকে দিল্লি যেমন খুশি তার রণনীতির জন্য ব্যবহার করতেই পারে। করবে না কেন? দিল্লি যদি মনে করে, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তাহলে প্রকাশ্য বা গোপন যেকোন সামরিক অভিযান চালানো গোলকায়নের (গ্লোবালাইজেশনের) এই যুগে খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দুনিয়াব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধেরই অংশ। দিল্লি সেই যুদ্ধেরই আঞ্চলিক সম্প্রসারণ ঘটাতেই পারে। ফলে এই ‘গুজব’ শাঁখের করাতের মতো কাজ করবে। স্বীকার করলে যা, না করলেও তাই।
ফেসবুকে আফসান চৌধুরী ইতোমধ্যে জনমত বোঝার জন্য প্রশ্ন করে সবার কাছে জানতে চাইছেন, ভারতীয় সৈন্য যদি জানমাল রার জন্য সাতীরার অভিযানে অংশগ্রহণ করে তাদের সমর্থন করা যায় কি না। যদি না যায় তার মানে একাত্তর সালে ভারতের সমর্থনÑ অর্থাৎ ভারতীয় সৈন্য আমাদের রা করবার জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ ও যুদ্ধ করার বিপইে আমরা তর্ক করছি। আর, ভারতীয় না হয়ে অন্য কোন দেশের সেনাবাহিনী যৌথ অভিযানে অংশগ্রহণ করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হোত কি না। আফসান চৌধুরী এই জনমত জরিপে কেন আগ্রহী হলেন তিনিই ভাল বলতে পারবেন। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য মতে যদি তা ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হয় তবে সেই ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ‘গুজব’ নিয়ে মতামত জরিপের আয়োজনও কি সমান ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ নয়? এ ছাড়া এসব সেন্সেটিভ ‘গুজব’ নিয়ে ছেলেখেলাও মারাত্মক বিপজ্জনক সন্দেহ নাই। তবে তিনি ঠিকই ধরেছেন আমাদের সমাজে এইভাবে চিন্তা করবার মানুষও আছে। তাদের মতামত জানার চেষ্টা এক দিক থেকে অনেক প্রশ্ন তৈরি করলেও যে কারোরই এই প্রশ্নগুলো সম্পর্কে অন্যদের মত জানার অধিকার হয়তো আছে, কিন্তু উসকানির দিকটা উপো করবেন কী করে? আর মানুষের জানমাল রার নামে হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশান বা মানবিক অভিযান তো দেশে দেশে চলছেই। নিজের পছন্দের হলে জাতিসংঘও তা অনুমোদন করে।
চার.
এবার খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন-পরবর্তী বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় সবাই উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। গণতন্ত্র সম্পর্কে সমাজে ধারণা ও চর্চার যে পার্থক্য সেই তর্ক থাকলেও নানা কারণে দেশে একটি সহনশীল পরিবেশ বজায় থাকুক এবং বর্তমান সংকটের একটি মীমাংসা হোক, সমাজের বড় একটি অংশ সেটাই চায়। যদিও আমি আমার লেখায় বারবার বলেছি রাজনৈতিক বিভাজনের যে বিষে বাংলাদেশ আক্রান্ত, সেই বিষ থেকে মুক্তি খুব সহজে ঘটবে বলে মনে হয় না। সেই তর্ক এখানে নতুন করে তুলব না।
মাঠের আন্দোলনের ধরনে সাময়িক বিরতি দিয়ে খালেদা জিয়া ২০ জানুয়ারি গণসমাবেশ ও ২৯ তারিখে কালো পতাকা মিছিলের ডাক দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতা এবং বিএনপির চরিত্রের কারণে উদার রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে খালেদা জিয়ার পে যাওয়া কঠিন। সেই দিক থেকে তাঁর বিরতির সময় নির্ধারণ ছিল সঠিক। বিশেষত হাউজ অব কমন্স ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বিতর্কের আগে আবারও সমঝোতার পথ খোলা রেখে নতুনভাবে আন্দোলন গোছানোর জন্য সময় নিয়েছেন তিনি। তার বক্তব্য ও অবস্থানের দুর্বলতা আগে উল্লেখ করেছি। এখন তার অর্জনের দিকগুলো বলব।
আন্দোলনে বিরতি দেওয়া ও সময় নেওয়াকে মতাসীনরা পরাজয় হিসেবে গণ্য করছে। মতাসীনদের পরে গণমাধ্যমগুলো আন্দোলনের কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেবার জন্য এই দিকগুলো ফলাও করে প্রচারও চালাচ্ছে। বিএনপি একটি নির্বাচনের দল। ফলে নির্বাচনের বাইরে থাকা এই দলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পদপে। তার পরও বলা দরকার খালেদা জিয়া আন্দোলন মাঠে রেখে কোন আপোষের মধ্য দিয়ে এখনো মতায় যেতে চাননি; এই দিকটা স্পষ্ট। তবে সামনে খোলা দুটো পথের একটার দিকে তিনি হাঁটছেন এটাই আমরা হয়তো এখন দেখব। যদিও দুটোই ‘যদি’, ‘কিন্তু’ ইত্যাদিতে ভরা।
প্রথম পথ; আপাতদৃষ্টিতে সহজ পথ। বিএনপির এখনকার চরিত্র আমলে নিয়ে কূটনৈতিক মহলের ওপর নির্ভর করে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে থাকা। এ পথেই তিনি থাকতে চান, আন্তর্জাতিক েেত্র বিশ্বাসযোগ্যভাবেই তিনি তা চাইলে দেখাতে পারেন। যদিও শেখ হাসিনা তাকে সে দিকে থাকতে দেবেন, নাকি ঘরে অথবা জেলে আটকে রাখবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। শেখ হাসিনার সরকার বেআইনি ও অবৈধ। এই সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। দিল্লি ছাড়া প্রায় সব দেশই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে আদৌ কোন নির্বাচন বলে গণ্য করছে না। তারা নতুন নির্বাচন চায়। জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে। কাজেই বিএনপির দিক থেকে বিচার করলে এগুলো স্পষ্টই আন্দোলনের নগদ বিজয়ের দিক। তিনি মতার বাইরে আছেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু সেটা সাময়িক। তাঁর মতায় যাবার পথ বাস্তব পরিস্থিতির নিজস্ব লজিকের কারণেই ঘটতে থাকবে। বেশ কিছু দেশের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছাচ্ছে যে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে সহনশীল ও উদার রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপিকে দুর্বল করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশকে, তাদের ভাষায়, ‘উগ্র রাজনীতির রণেেত্র’ পরিণত করা। ফলে নতুন নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনার ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে। এই দিক থেকে বিচার করলে আন্দোলন বিএনপির জন্য ইতিবাচক ত্রে তৈরি করেছে। এটা আমরা কমবেশি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।
যদিও এই লেখার শুরুতে বলেছি গণ-আন্দোলন সহিংস থাকবে নাকি অহিংস হবে তা মূলত নির্ভর করে মতাসীনদের আচরণের ওপর। অর্থাৎ খালেদার ভূমিকা সেকেন্ডারি। আর দমন-পীড়নে মতাসীনেরা যদি লাভের গুড় বেশি দেখে তবে গণ-আন্দোলনকে সহিংস দিকে তারাই ঠেলে দেবে। এই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে হাত-পা বেঁধে ঘরে বা জেলে রাখতে মতাসীনরা কুণ্ঠিত হবে না। আসলে এই পথে খালেদার সাফল্য নির্ভর করছে মূলত হাসিনার ওপর কূটনৈতিক মহলের চাপ সৃষ্টি করা এবং সেই চাপের সাফল্যের ওপর। তার অর্থ তাকে দ্রুত আরেকটি নির্বাচনে বাধ্য করা। এই সম্ভাবনার ওপর আস্থা রাখার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। এক কথায় বললে, পরাশক্তির ভাষায় বাংলাদেশকে ‘উগ্র রাজনীতির রণেেত্র পরিণত করার’ বিপদ ঠিক তাদের মতো করে দেখতে হাসিনাকে এখনো তারা রাজি করাতে পারেনি; এমনকি রাজি করানোর ধারেকাছেও যেতে পারেনি। ফলে এপথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সুরাহা হবে কি না এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। চূড়ান্তভাবে কী ধরনের চাপ পারাশক্তিগুলো শেখ হাসিনার ওপর প্রয়োগ করছে তার ওপর সেটা নির্ভর করবে।
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় যে জয় সেটা হচ্ছে একটি অসাম্প্রদায়িক ও লিবারেল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নস্যাৎ করে দেওয়া। আমার মনে হয়, খালেদা জিয়ার মতায় যাবার চেয়ে আওয়ামী রাজনীতির এই ভণ্ড দিকটি উন্মোচন আন্দোলনের বিশাল সাফল্য। আওয়ামী লীগের যে ভাবমূর্তি ছিল, খালেদা জিয়া তা দেশে-বিদেশে মারাত্মকভাবে ুণœ করতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক তাঁরা দলটিকে অসাম্প্রদায়িকতার জন্য সমর্থন করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যারা সমালোচক তারা দীর্ঘ দিন ধরেই বলে আসছে যে, আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক দল নয়। তাদের মুখে ফুলচন্দন দিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের সাম্প্রদায়িক চরিত্র এবার প্রকটভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে। নিজের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি উদ্ধার করা আওয়ামী লীগের জন্য খুবই কঠিন হবে। যেসব এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনার জায়গাগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এবারই প্রথম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদসহ যারা নিজেদের ‘সেকুলার জনগোষ্ঠী’ মনে করে, তারা দাঙ্গার জন্য প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগকেও দায়ী করেছে। এর দায় একতরফা ইসলামপন্থী দল ও বিএনপির ওপর চাপিয়ে দেবার প্রাণান্ত চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগ সফল হয়নি।
খালেদা জিয়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টানসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী ও নাগরিকদের সুরার কথা বারবার বলেছেন, কিন্তু তাকে কার্যকর করবার েেত্র তার জোটের প থেকে সুনির্দিষ্ট কোন পদপে ও তৎপরতা দেখা যায়নি। হতে পারে, সরকারি দমন-পীড়নের মুখে সেটা সম্ভব ছিল না। এই অজুহাত দেওয়াই যায়। কিন্তু দুর্বল ও অসহায় নাগরিকদের জান, মাল ও উপাসনার ত্রে এবং আক্রান্ত জনপদগুলোতে সরাসরি হাজির থেকে প্রাণ দিয়ে তাদের রা করার মধ্য দিয়েই বিএনপিসহ তার জোটের সদস্যরা বাংলাদেশের মর্যাদা অুণœ রাখতে সম হতে পারেন। এটাই একমাত্র পথ, কাগুজে ঘোষণা দিয়ে নয়। সাম্প্রদায়িকতাকে কোনভাবেই বরদাশনা করবার যে নীতির কথা খালেদা জিয়া বলেন, এবার তাকে যেকোন মূল্যে সেটা প্রমাণ করতে হবে।
তৃতীয়ত; আওয়ামী লীগ দিল্লির বশংবদ একটি রাজনৈতিক দল এই ভাবমূর্তি আরো গভীর হয়েছে। সাধারণ জনগণের বিশ্বাস অর্জন শেখ হাসিনার পে আগের চেয়েও তুলনামূলকভাবে কঠিন হবে। এ েেত্র কতিপয় গণমাধ্যমের নীতিনৈতিকতা-বিবর্জিত নির্লজ্জ মিথ্যাচার ও প্রপাগান্ডা কোন কাজে আসবে না। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নিরন্তর দমন-পীড়ন ছাড়া শেখ হাসিনার পে রাষ্ট্র পরিচালনা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠবে।
পাঁচ.
খালেদা জিয়ার সামনে দ্বিতীয় যে পথ খোলা আছে সেটা কঠিন। সেটা বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের পথ। সেই পথে তিনি অনেক দূর এসেছেন। আগামী দিনে কত দূর যাবেন এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তাঁকে ভেবে দেখতে হবে কূটনৈতিক মহল হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে নতুন নির্বাচনে বাধ্য করতে আদৌ সম হবার সম্ভাবনা আছে কি না। ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি হাসিনা এই ধরনের চাপের তোয়াক্কা করেন না। খালেদা জিয়াকে ভাবতে হবে শুধু বাইরের চাপে শেখ হাসিনার অবৈধ ও বেআইনি সরকার পরাস্ত হবে না। যদি হোত সেটা অনেক আগেই ঘটত। কূটনৈতিক মহলের ঘাড়ে বসে একটা নির্বাচন পাবার সম্ভাবনা আগের চেয়ে এখন হয়তো একটু বেশি। কিন্তু কূটনৈতিক সমর্থন তা নিশ্চিত করবার জন্য যথেষ্ট নয়। খালেদা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলেও রক্তয়ী সংগ্রাম ছাড়া তা আদায় করা সম্ভব কি না, তা নিয়েও ঘোর সন্দেহ রয়ে গিয়েছে।
শেখ হাসিনা গণবিচ্ছিন্ন এবং মতায় থাকার বৈধতা তাঁর নাইÑ এর সবই সত্য। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে বুঝতে হবে, শেখ হাসিনা নন, তাঁকে কার্যত লড়তে হচ্ছে দিল্লির বিরুদ্ধে। বিশেষভাবে দিল্লির দণি এশীয় রণনীতির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বাস্তবতাই আজ নির্ধারক শর্ত। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনরত জনগণের সঙ্গে তিনি কত দূর যাবেন সেই সিদ্ধান্ত তাঁর।
ইতিহাসের সদর রাস্তায় সবাই হাঁটবার হিম্মত রাখেন না। তাঁদের সংখ্যা স্বল্পই হয়। খালেদা জিয়া নিজেকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করবেন কি না, সেটা একান্তই তাঁর নিজের। দেখা যাক ভবিষ্যৎ আমাদেরকে কী দেখাতে পারে!
১৮ জানুয়ারি ২০১৪। ৫ মাঘ ১৪২০। আরশিনগর।
Daily Naya Diganta
ফরহাদ মজহার
২২ জানুয়ারি ২০১৪, বুধবার, ৯:২৯
এক.
আগের লেখায় আন্দোলনের ধরন নিয়ে আলোচনা করেছি (দেখুন, ‘হাসিনার নয় দফা ও আন্দোলনের ধরন’Ñ নয়া দিগন্ত, ১৯ জানুয়ারি ২০১৪)। সেই প্রসঙ্গে ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পন্ন হবার পর তখনকার বর্জনের নেত্রী শেখ হাসিনার বিখ্যাত ‘নয় দফা’র কথাও সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছি। বেগম খালেদা জিয়া ১৫ জানুয়ারিতে যে কর্মসূচি ও বক্তব্য দিয়েছেন তার সঙ্গে শেখ হাসিনার নয় দফা তুলনা করলে মনে হয় বিএনপি আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট অর্জন সম্পর্কে অস্পষ্ট। অন্য দিকে গণমাধ্যমের প্রপাগান্ডায় আন্দোলনের ধরন নিয়ে উৎকণ্ঠিত।
বিএনপি আইন মেনে চলা ভোটাভুটির দল। উদার ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যেই তাকে থাকতে হবে। তাই এই উৎকণ্ঠা স্বাভাবিক। কিন্তু উৎকণ্ঠাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিএনপি অতীতে বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনে যেভাবে সন্ত্রাস ও সহিংসতা ঘটেছে, তার ইতিহাস মনে রাখেনি। অস্বীকার করবার উপায় নাই যে স্বাধীনতার পর অতীতের যেকোন আন্দোলনের চেয়ে এবারের আন্দোলন ছিল ব্যাপক ও জনগণের অংশগ্রহণও ছিল বিপুল। ঢাকা অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঘটনা এর আগে একাত্তরের পর দেখা যায়নি। আন্দোলনের দিক থেকে এটা ছিল সুস্পষ্ট বিজয়; জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের এই শক্তিকে খালেদা জিয়া কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছেন, বলা মুশকিল। কারণ ২৯ ডিসেম্বরের শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রের অভিযাত্রা সরকারের মারমুখী সহিংসতার কারণে সফল করা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের মাত্রা অতীতের যেকোন আন্দোলনের তুলনায় সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাস্তায় নামার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবার নজির অবিশ্বাস্য। আন্দোলনের বিস্তার ও বিপুল অংশগ্রহণের ফলে সহিংসতা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি দৃশ্যমান ছিল।
তবে জনগণের প্রতিরোধের রূপ বা ধরনের দিক থেকে, এবারও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মোকাবিলা অতীতের গণ-আন্দোলনের ধরন কিম্বা মাত্রা অতিক্রম করেনি। এই দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে কেউ গ্রেনেড বা স্বয়ংক্রিয় কোন অস্ত্র নিয়ে নেমে পড়েছে, এমন কোন নজির বা অভিযোগের কথা জানা যায় নাই। গানপাউডার দিয়ে বাস ও বাসের আরোহীদের পুড়িয়ে মারা, মলটভ ককটেল (১৮ দল ছুড়লে যার নাম বদলে গিয়ে হয় ‘পেট্রল বোমা’) মেরে যানবাহন আগুনে ছাই করে দেয়া, রেলস্টেশন পুড়িয়ে ফেলা, রেললাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলাÑ ইত্যাদি সকল প্রকার ‘তাণ্ডব ও সন্ত্রাস’ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দেখিয়েছেন এবং শিখিয়েছেন, তার খালেদা জিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলনে দুই পর্বে। এটাই এ দেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ বা ফর্ম হিসেবে আন্দোলনের ধরন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার বিরোধী দল বারবার অনেক ঘটনাকে সরকার পরেই করা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ বলে নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছে, এ েেত্র তাদের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন সুষ্ঠু ও নিরপে তদন্ত হয়নি। সরকারপীয় গণমাধ্যমগুলোর একপীয় মিথ্যাচারে সত্য আড়াল হয়ে গিয়েছে।
ুব্ধ হয়ে বাসে আগুন দেয়া এক জিনিস আর গানপাউডার সাথে বয়ে নিয়ে বাসে আগুন দেয়া চরিত্রের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধরন। এমনকি যাত্রীদের নামার সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়নি। যানবাহনে অগ্নিসংযোগের েেত্র এই দুই ধরনের রূপ আরো ঘনিষ্ঠ পর্যালোচনার দাবি রাখে। মানুষকে বাস থেকে বের হতে না দিয়ে গানপাউডার দিয়ে আগুন লাগানো এবং পুড়ে যাওয়া অসহায় মানুষগুলোকে বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা ও ক্রমাগত জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-বিােভের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রচারের কাজে ব্যবহারের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। এর কোন জবাব এখনো মেলেনি। এভাবে পুড়িয়ে মারা ও বার্ন ইউনিটে তা প্রদর্শনের প্রপাগান্ডা কৌশল মতাসীনদের দমনমূলক রাজনীতিকেই মদদ জোগায়। অপকর্মটি বিরোধী রাজনীতির কাণ্ড কি না সন্দেহ সৃষ্টি করে। ফলে এর নিরপে ও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া খুবই জরুরি।
সরকারি সশস্ত্রতার বিরুদ্ধে অনন্যোপায় হয়ে পাল্টা ভয় দেখানোর শব্দ তৈরি করা বা ঘরে বোমা তৈরি করে ভীতিকর ধোঁয়া সৃষ্টি করার ‘আরবান টেররাইজেশন’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারে গণ-আন্দোলনের সীমার মধ্যকার তৎপরতা বলেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। একেও অনেকে নিন্দা করতে পারেন, ঠিক আছে। কিন্তু এর কারণে গণবিােভের ন্যায্যতাকে নাকচ করে দেবার রাজনীতি সমর্থনের সুযোগ নাই। সেটা হয়ে দাঁড়ায় মতাসীনদের রাজনীতি ও তাদের প্রপাগান্ডার অস্ত্র। অথচ তারা নিজেরা এর চেয়েও অনেক বেশি সন্ত্রাস ও সহিংসতা করেই আজ মতায় বসে আছেন। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যাকাণ্ডের কথা না-ই বা তুললাম!
আন্দোলন-সংগ্রামে ুব্ধ ও সীমিত সহিংস চরিত্র থাকা, আর মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া এক কথা নয়। গানপাউডার ব্যবহার আর সর্বোপরি যাত্রীদের নেমে যাবার সময় ও সুযোগ না দিয়ে আগুনে পোড়ানো সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া সহিংসতা। কারা তা করেছে তা খুঁজে বের করা ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান নাভি পিল্লাইও তার হুঁশিয়ারিমূলক বিবৃতিতে, ‘আরোহী যাত্রীদের নামার সময় ও সুযোগ না দিয়ে’ যানবাহনে আগুন দেবার কথা স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছিলেন। প্রাণহানিতে নিহত মানুষ ফিরিয়ে আনা যায় না, অন্য সব তি হয়তো পূরণীয়। ফলে এ কাজ নিন্দনীয় এবং আন্দোলনের এই আওয়ামী ধরনকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কিন্তু পটকা বা ঘরে তৈরী বোমা এর আগেও ব্যবহার করা হয়। এবারও হয়েছে।
যেটা নতুন সেটা হচ্ছে রাস্তায় মিছিল নিয়ে নামা মাত্রই পুলিশের গুলি চালানো। বুক ও মাথা ল্য করে হত্যার জন্য গুলি ছোড়া এর আগে ছিল না। নতুন প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রত্য অংশগ্রহণকারীদের থেকে শোনা, তারা বলছেন দশজনেরও একটা মিছিল নিয়ে যদি রাস্তায় নামতে চাই আর সাথে যদি দুইটা ককটেলও না থাকে তবে পুলিশের গুলি খেয়ে মরতে হবে। কারণ পুলিশ আমাদের দেখে ফেললে তাদের ভয় দেখানোর জন্য আমাদের কয়েক সেকেন্ড সময় দরকার, যাতে দ্রুত নিরাপদ একটা অবস্থানে সরে গিয়ে আশ্রয় জুটিয়ে নিতে পারি। এ কাজে ককটেলের ভয় দেখানো ধোঁয়া আর শব্দ একটু কাজের হয়, কিছুটা সময় দেয়। বেশ কিছু জায়গায়, বিশেষত রাজশাহী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় দেখা গিয়েছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে সাধারণ পোশাকে কিছু ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিােভকারীদের ওপর হামলা করছে। রাষ্ট্র বা সরকারি বাহিনীর সন্ত্রাস ও তার সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদেরই আশ্রয়ে মতাসীনদের দলীয় সহিংসতার এই ধরনগুলো অতীতে মুজিব আমলেও দেখা যেত। বলা বাহুল্য গণমাধ্যমগুলোর বেশির ভাগই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কিভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধকেই তাদের প্রপাগান্ডার কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত করেছে। এই সময় কতজন মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি এবং নির্যাতনে নিহত হয়েছেন এবং বিপরীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধে কী পরিমাণ প্রাণহানি ঘটেছেÑ এই দুই পরিসংখ্যানের মধ্যকার ফারাক বিস্ময়কর। বাংলাদেশের বেয়াল্লিশ বছরের ইতিহাসে এত বড় হত্যাযজ্ঞ এর মাঝে ঘটেনি।
তবুও বলা দরকার যারা রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা চান না, তাদের সংবেদনার সঙ্গে আমরা একদমই একমত। কিন্তু সেটা বন্ধ করতে হলে প্রথমে নজর দিতে হবে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ওপর। নাগরিকরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র ও সমাজ তৎণাৎ ভেঙে পড়ে না। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার যখন সংবিধান, আইন, মানবাধিকার কিম্বা নীতিনৈতিকতা, নাগরিক ও মানবিক অধিকার কিছুই মানে না, নিজেই নিজের নাগরিকদের বিচার ছাড়া হত্যা করে, তখন রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা ভেঙে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তখন সন্ত্রাস ও সহিংসতা যে উচ্চ মাত্রায় পৌঁছায় তা অভীষ্ট ল্েয পৌঁছানো ছাড়া তুরীয় উত্তাপ থেকে নেমে আসা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা কমিয়ে আনা দ্বিতীয়ত নির্ভর করে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের ভূমিকার ওপর। যদি সরকারের নীতি হয় দিল্লির আত্মঘাতী রণনীতি বাস্তবায়নÑ অর্থাৎ যেভাবেই হোক বাংলাদেশ থেকে ইসলামপন্থীদের শারীরিক অর্থে নির্মূল, তাহলে আন্দোলনকে সহিংস করবার দায়দায়িত্ব ষোল আনা মতাসীনদের। অথচ আইনের শাসন ও শক্তিশালী নিরপে বিচারব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতিচর্চার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা কমিয়ে আনার কার্যকর শর্ত তৈরি করা সম্ভব।
এমনিতেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরায় রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল বা গ্রুপ এবং সব নাগরিককে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাখার রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝার সামর্থ্য আমাদের নাই বললেই চলে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি তখনই সম্ভব যখন নাগরিক অধিকারের সীমার মধ্যে সব ধরনের রাজনীতি ও মতাদর্শ চর্চা করার সুযোগ অবাধ থাকে। এই মৌলিক সূত্রের দিকে নজর ফেরানোর মতো রাজনৈতিক দিশা সমাজে ও সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত। বিএনপিও এসব দিকে খোঁজখবর রাখে বলে মনে হয় না, তাদের আগ্রহও দেখা যায় না। অথচ এটাই হতে পারত জনগণকে বিভক্ত নয়, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করার মূলনীতি।
হাসিনার নয় দফার সঙ্গে তুলনা করলে আমরা দেখব গণ-আন্দোলনের কৌশল সম্পর্কে বিএনপি যারপনাই অস্পষ্ট, এখন অবধি আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে তারা গভীরভাবে ভাবেনি। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার েেত্র নীতি ও কৌশল নির্ণয় করবার দুর্বলতাগুলো তাদের মধ্যে প্রকট। এটা এখন বেশি ধরা পড়ছে কারণ বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন অতীতের যেকোন আন্দোলনের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের ভবিষ্যৎ নির্ণয়ের েেত্র নির্ধারক হয়ে উঠেছে। বিএনপির নেতারা খেয়াল করলে দেখতেন, শেখ হাসিনা কিভাবে আন্দোলন করতে চাইছেন। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বিরাট কোন থিসিস হাজির করেননি। যে বক্তব্য নির্বাচনী ইশতেহারে থাকার কথা সে বক্তব্য আন্দোলনের মাঝখানে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনে দেওয়াটাও দুর্বল সিদ্ধান্ত ছিল। এই মুহূর্তে সেটা ছিল বেদরকারি। মনে হয়েছে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কাটপেস্ট করে বেখাপ্পাভাবে বেগম জিয়ার বক্তব্যের মাঝখানে কিছু বক্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা গত আন্দোলনে সরকার উৎখাতের কথাই বলেছিলেন, যে সরকারকে ‘অবৈধ’ বলেছেন, তাদের সঙ্গে সমঝোতার কথা বলেননি। সংবিধান ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কিভাবে ‘অবৈধ’ সরকার উৎখাত করতে হবে তার ফর্মুলাই তিনি হাজির করেছিলেন। সংবিধানের মধ্যে থেকেও কিভাবে মতাসীন সরকারকে উৎখাত করা যায় সে কথাই নয়টি দাবির মধ্য দিয়ে পেশ করেছেন। যে কারণে গত লেখা আমি নয় দফার ওপর লিখেছি।
খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারকে অবৈধ বলছেন, তাহলে নিয়মতান্ত্রিক দল হিসেবে আইন ও সংবিধানের মধ্যে থেকে এই ধরনের সরকারকে উৎখাতের ফর্মুলাই জনগণ তাঁর কাছে চেয়েছে। শিখতে হবে, খালেদার বিরুদ্ধে যখন সহিংস আন্দোলন করছিলেন তখন ‘অবৈধ’ সরকারের সাথে সমঝোতা বা সংলাপ করতে হাসিনা চাননি, আহবানও জানাননি।
দুই.
হাউজ অব কমন্স ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্কের সারকথা হচ্ছে জবরদস্তি ঢাকায় যারা মতায় রয়েছে তাদের ওপর দ্রুত নির্বাচন করবার জন্য মৃদু চাপ সৃষ্টি। ধারণা করা যায়, যে চাপই আসুক কাজ হবে না। শেখ হাসিনা খানিক বিরক্ত হবেন হয়তো, যথারীতি তিনি তা এড়িয়ে চলবেন। দণি এশিয়ার জন্য নির্ধারিত দিল্লির রণনীতিটাই তিনি অনুসরণ করবেন। তাঁর গণবিচ্ছিন্নতা বিবেচনায় রেখে নির্মোহভাবে বিচার করলে এই নীতি অনুসরণই তাঁর দিক থেকে সঠিক। তার সামনে আর কোন পথ খোলা নাই। এর সঙ্গে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিশেষত দণি-পূর্ব ভারতের প্রশ্ন জড়িত। বাংলাদেশে যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি করবার মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যা সমাধানের নীতি দিল্লির চোখ দিয়ে দেখতে হবে। দেখলে দিল্লির রণনীতি ও শেখ হসিনার রণরঙ্গিনী মূর্তি মোটেও ভুল বা মন্দ বলা যাবে না। অর্থাৎ দিল্লীর স্বার্থের দিক থেকে তাকালে এটাই উভয়ের জন্য সবচেয়ে লাভজনক নীতি। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বিদ্রোহ সমূলে উৎখাত করতে চাইলে দিল্লির কাছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে ভাল সুযোগ ভবিষ্যতে দিল্লির জন্য আসবে কি না সন্দেহ। অতএব শেখ হাসিনাকে নিঃশর্তভাবে সমর্থনই দিল্লি ঠিক মনে করছে। সম্ভবত এই ধরনের নির্বাচনই দিল্লি চেয়েছে। হাসিনার বিপে বাংলাদেশের জনগণের ভোট দেওয়া ও তাকে মতা থেকে সরিয়ে দেবার প্রক্রিয়াটাই দিল্লি রুখতে চেয়েছে। এখন অবধি দিল্লি ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ অর্থাৎ ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’দের দমন করা দুই দেশের নিরাপত্তার জন্য দরকারি বলে জনমত গড়তে পারছে। এটা ছল হলেও দিল্লি এখনো এতে সফল। সফলতার অর্থ হচ্ছে ভারতীয়দের এই প্রচারণায় বোঝানো যাচ্ছে, শেখ হাসিনাকে মতায় রেখে ইসলামপন্থীদের দমন করা না গেলে বাংলাদেশে আবার উত্তর-পূর্ব ভারত ও কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ক্যাম্প গাড়বে এবং সীমান্তের ওপার থেকে ভারতের অভ্যন্তরে সহিংস কার্যকলাপ চালিয়ে যাবে। অতএব দিল্লি-ঢাকা যৌথ অভিযানের এই রণনীতি ভারতের নিরাপত্তার জন্যই জরুরি। ঘন ঘন বাংলাদেশের অমুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন নিজে সৃষ্টি করে হলেও হিন্দু সম্প্রদায়কে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িক ও হিন্দুবিদ্বেষী মুসলমানদের হাত থেকে রা করার জন্য এই নীতিটা চালিয়ে যাওয়া দরকার।
অন্য দিকে দিল্লির ধারণা, বাংলাদেশের জনগণকেও বোঝানো যাচ্ছে এটা একাত্তর সালের মতো স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরে শক্তির রণধ্বনিও অভিন্ন। দিল্লির এই রণনীতির পে বাংলাদেশে শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম রয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশপন্থী গণমাধ্যম নাই বললেই চলে। সর্বশেষ দৈনিক ইনকিলাবও সিলগালা হয়ে গেল, তার প্রকাশনা আটকে দেয়া হয়েছে।
শাহবাগের আন্দোলন দিল্লির রণনীতির পে শক্তিশালী যুক্তি। শাহবাগের বিশাল ‘গণজাগরণ’ এটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের জনগণ জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও নানান কিসিমের ইসলামি দলের হাত থেকে নিষ্কৃতি চায়। দিল্লি যুক্তি দিচ্ছে, এই ‘অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপে’ শক্তিকে ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে কাজে লাগানো উচিত। অতএব একাত্তর সালে ভারতীয় সৈন্যসহ দিল্লি যেভাবে বাংলাদেশকে সরাসরি যুদ্ধে সমর্থন করেছিল সেই একইভাবে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করে ইসলামপন্থীদের এখনই ‘নির্মূল’ করতে হবে। আফটার অল, এটা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংলাপ তখনই করা হবে যখন তিনি জামায়াত ও হেফাজতকে ত্যাগ করে আসেন। তিনি যদি না আসেন তাহলে বিএনপির মধ্যে জামায়াতবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের পরে নেতা ও কর্মীদের বড় একটি অংশই তাঁকে ত্যাগ করে নতুন দল গঠন করবে এবং দিল্লির রণনীতি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। এ প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক টাইমসের দ্বিতীয় রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে উদ্ধৃত করে লেখায় তার মন্তব্য পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। বাংলাদেশের একাত্তরের অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে দিল্লি ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সকল প্রকার বিদ্রোহের সমুচিত জবাব দিতে চায়।
এটা ভাববার কোনই কারণ নাই যাঁরা শাহবাগে অংশগ্রহণ করেছেন এবং যারা একে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গণ্য করেন তাদের সবার সঙ্গে দিল্লির এই রণনীতির আদৌ কোন সম্পর্ক রয়েছে। বরং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ শাহবাগকে সমর্থন দেওয়ায় শাহবাগের আন্দোলনের তি হয়েছে। বাংলাদেশের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যারা আন্তরিকভাবেই চেয়েছেন তাঁরা কোনভাবে দিল্লির এই রণনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত নন। বিশাল একটি অংশ শেখ হাসিনার রাজনীতিরও সমর্থক কি না সন্দেহ। আওয়ামী লীগের প্রতি পপাত রয়েছে, কিন্তু দলটির এখনকার রাজনীতির সমর্থক নন তাঁদের সংখ্যাও শাহবাগে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কম নয়। তবে ুদ্র একটি অংশ এখনো আওয়ামী রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
দিল্লির এই রণনীতির পে ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণ থাকবে এই অনুমানও ভুল। আমরা শুধু দাবি করতে চাইছি বেআইনি ও অবৈধ সরকারবিষয়ক সঙ্কট ও বর্তমান গণবিচ্ছিন্নতার কারণে শেখ হাসিনা বিপদে আছেন, দুর্বল তিনি। এই দুর্বলতার জন্য দিল্লির এই রণনৈতিক অবস্থানের ফাঁদে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে যেতে তিনি বাধ্য এবং তার পরিণতি বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের জন্য শুভ পরিণতি বয়ে আনবে না। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক দাবি করেন যে দিল্লির পররাষ্ট্রনীতি যে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় তা ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা ঠিক হয় না। বরং ঠিক হয় সাউথ ব্লকে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে; আর তা ঠিক করেন আমলারা। এটা পরিষ্কার, বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির বর্তমান নীতি বাস্তবতাবর্জিত, এই নীতির মধ্যে প্রাজ্ঞতা, বিচণতা ও দূরদৃষ্টির প্রকট অভাব রয়েছে। শেখ হাসিনার দুর্বলতার সুযোগ দিল্লি পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করছে। দিল্লির নিঃশর্ত সমর্থনের জোরে অন্যান্য দেশের প থেকে দেওয়া চাপ হাসিনা তোয়াক্কা করবেন না; এটাই বলতে চাইছি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ফরাসি, ওলন্দাজ ও জার্মানদের বর্ণবাদ ও ইসলামবিদ্বেষ অপরিচিত কিছু নয়। তারা শেখ হাসিনার ইসলাম দমনকে প্রশংসার চোখেই দেখে। দিল্লি জানে একটা পর্যায়ে ‘ইসলামি সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে দিল্লি-ঢাকা যৌথ অভিযানের প্রতি ইউরোপের সমর্থন থাকবে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তিন.
এবার ‘গুজব’। ইন্টারনেটে ওয়েবসাইট ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন আসমানি নেটওয়ার্কগুলো ‘বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি’র কথিত তথ্যে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে এবং ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই সব তথ্যকে ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে। পাশাপাশি দৈনিক ইনকিলাবের সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও প্রেস সিলগালা করে দিয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। তারা সেই কথিত তথ্যের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকারের কথাও ছেপেছিল। খবরটির শিরোনাম করেছিল, ‘সাতীরায় যৌথবাহিনীর অপারেশনে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা! : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকার’Ñ এভাবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতির খবর ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেটা অবশ্যই হতে পারে বা হয়তো আসলেই তা-ই। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়ে প্রমাণ না করে গণমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর কারণে বিষয়টির মীমাংসা হবে না। বরং আরো জটিল হবে; সন্দেহকে আরো তীব্র করবে। বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে ভারতীয় গোয়েন্দারা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের এর আগেও ধরে নিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে ভারতীয় অপারেটিভদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তৎপরতা চালানো নতুন তথ্য নয়। দ্বিতীয়ত নিজের দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ দমনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, এ েেত্র তাদের অভিজ্ঞতাও প্রচুর। এ অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে সাতীরার পরিস্থিতি দমনে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ও গণবিচ্ছিন্ন সরকার দিল্লির কাছে সামরিক সাহায্য চাইতেই পারে। দিল্লি নিজ দেশের বাইরে এই ধরনের গোপন অভিযানে অংশ নিয়েছে কি না সেটা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা ও গোপনীয়তাই এই তর্ককে বিপজ্জনক করে তুলেছে।
গুজব হোক কি সত্য হোক, আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এই খবরের রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশের জনগণ কিম্বা বাংলাদেশের সরকার এই ধরনের গুজবের প্রতি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে তার দ্বারা দিল্লির প্রতি বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সংবেদনা পরিমাপ করা যাবে। এই অঞ্চলে আগ্রহী প্রতিটি পরাশক্তি তাকে গুরুত্বের সঙ্গেই পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে দণি এশিয়ার নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র কেমন হতে পারে তা এই প্রতিক্রিয়া থেকে আন্দাজ করা যাবে অনায়াসেই। দিল্লি চাইলেও এই ‘গুজব’কে হাল্কা করতে পারবে না।
অন্য দিকে ‘সার্বভৌমত্ব’ সংক্রান্ত প্রাচীন ধারণা মাথায় রেখে শক্তিশালী দেশগুলো আজকাল আর কাজ করে না। সেটা আমরা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেÑ বিশেষত লিবিয়া, সিরিয়ায় দেখেছি। ফলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বিদেশী সৈন্য ঢুকে পড়তেই পারে। এটা অবাক হবার মতো কোন
অবাস্তব ‘গুজব’ নয়। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাই বলে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও দুর্বল দেশকে দিল্লি যেমন খুশি তার রণনীতির জন্য ব্যবহার করতেই পারে। করবে না কেন? দিল্লি যদি মনে করে, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তাহলে প্রকাশ্য বা গোপন যেকোন সামরিক অভিযান চালানো গোলকায়নের (গ্লোবালাইজেশনের) এই যুগে খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দুনিয়াব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধেরই অংশ। দিল্লি সেই যুদ্ধেরই আঞ্চলিক সম্প্রসারণ ঘটাতেই পারে। ফলে এই ‘গুজব’ শাঁখের করাতের মতো কাজ করবে। স্বীকার করলে যা, না করলেও তাই।
ফেসবুকে আফসান চৌধুরী ইতোমধ্যে জনমত বোঝার জন্য প্রশ্ন করে সবার কাছে জানতে চাইছেন, ভারতীয় সৈন্য যদি জানমাল রার জন্য সাতীরার অভিযানে অংশগ্রহণ করে তাদের সমর্থন করা যায় কি না। যদি না যায় তার মানে একাত্তর সালে ভারতের সমর্থনÑ অর্থাৎ ভারতীয় সৈন্য আমাদের রা করবার জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ ও যুদ্ধ করার বিপইে আমরা তর্ক করছি। আর, ভারতীয় না হয়ে অন্য কোন দেশের সেনাবাহিনী যৌথ অভিযানে অংশগ্রহণ করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হোত কি না। আফসান চৌধুরী এই জনমত জরিপে কেন আগ্রহী হলেন তিনিই ভাল বলতে পারবেন। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য মতে যদি তা ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হয় তবে সেই ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ‘গুজব’ নিয়ে মতামত জরিপের আয়োজনও কি সমান ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ নয়? এ ছাড়া এসব সেন্সেটিভ ‘গুজব’ নিয়ে ছেলেখেলাও মারাত্মক বিপজ্জনক সন্দেহ নাই। তবে তিনি ঠিকই ধরেছেন আমাদের সমাজে এইভাবে চিন্তা করবার মানুষও আছে। তাদের মতামত জানার চেষ্টা এক দিক থেকে অনেক প্রশ্ন তৈরি করলেও যে কারোরই এই প্রশ্নগুলো সম্পর্কে অন্যদের মত জানার অধিকার হয়তো আছে, কিন্তু উসকানির দিকটা উপো করবেন কী করে? আর মানুষের জানমাল রার নামে হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশান বা মানবিক অভিযান তো দেশে দেশে চলছেই। নিজের পছন্দের হলে জাতিসংঘও তা অনুমোদন করে।
চার.
এবার খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন-পরবর্তী বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় সবাই উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। গণতন্ত্র সম্পর্কে সমাজে ধারণা ও চর্চার যে পার্থক্য সেই তর্ক থাকলেও নানা কারণে দেশে একটি সহনশীল পরিবেশ বজায় থাকুক এবং বর্তমান সংকটের একটি মীমাংসা হোক, সমাজের বড় একটি অংশ সেটাই চায়। যদিও আমি আমার লেখায় বারবার বলেছি রাজনৈতিক বিভাজনের যে বিষে বাংলাদেশ আক্রান্ত, সেই বিষ থেকে মুক্তি খুব সহজে ঘটবে বলে মনে হয় না। সেই তর্ক এখানে নতুন করে তুলব না।
মাঠের আন্দোলনের ধরনে সাময়িক বিরতি দিয়ে খালেদা জিয়া ২০ জানুয়ারি গণসমাবেশ ও ২৯ তারিখে কালো পতাকা মিছিলের ডাক দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতা এবং বিএনপির চরিত্রের কারণে উদার রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে খালেদা জিয়ার পে যাওয়া কঠিন। সেই দিক থেকে তাঁর বিরতির সময় নির্ধারণ ছিল সঠিক। বিশেষত হাউজ অব কমন্স ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বিতর্কের আগে আবারও সমঝোতার পথ খোলা রেখে নতুনভাবে আন্দোলন গোছানোর জন্য সময় নিয়েছেন তিনি। তার বক্তব্য ও অবস্থানের দুর্বলতা আগে উল্লেখ করেছি। এখন তার অর্জনের দিকগুলো বলব।
আন্দোলনে বিরতি দেওয়া ও সময় নেওয়াকে মতাসীনরা পরাজয় হিসেবে গণ্য করছে। মতাসীনদের পরে গণমাধ্যমগুলো আন্দোলনের কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেবার জন্য এই দিকগুলো ফলাও করে প্রচারও চালাচ্ছে। বিএনপি একটি নির্বাচনের দল। ফলে নির্বাচনের বাইরে থাকা এই দলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পদপে। তার পরও বলা দরকার খালেদা জিয়া আন্দোলন মাঠে রেখে কোন আপোষের মধ্য দিয়ে এখনো মতায় যেতে চাননি; এই দিকটা স্পষ্ট। তবে সামনে খোলা দুটো পথের একটার দিকে তিনি হাঁটছেন এটাই আমরা হয়তো এখন দেখব। যদিও দুটোই ‘যদি’, ‘কিন্তু’ ইত্যাদিতে ভরা।
প্রথম পথ; আপাতদৃষ্টিতে সহজ পথ। বিএনপির এখনকার চরিত্র আমলে নিয়ে কূটনৈতিক মহলের ওপর নির্ভর করে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে থাকা। এ পথেই তিনি থাকতে চান, আন্তর্জাতিক েেত্র বিশ্বাসযোগ্যভাবেই তিনি তা চাইলে দেখাতে পারেন। যদিও শেখ হাসিনা তাকে সে দিকে থাকতে দেবেন, নাকি ঘরে অথবা জেলে আটকে রাখবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। শেখ হাসিনার সরকার বেআইনি ও অবৈধ। এই সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। দিল্লি ছাড়া প্রায় সব দেশই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে আদৌ কোন নির্বাচন বলে গণ্য করছে না। তারা নতুন নির্বাচন চায়। জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে। কাজেই বিএনপির দিক থেকে বিচার করলে এগুলো স্পষ্টই আন্দোলনের নগদ বিজয়ের দিক। তিনি মতার বাইরে আছেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু সেটা সাময়িক। তাঁর মতায় যাবার পথ বাস্তব পরিস্থিতির নিজস্ব লজিকের কারণেই ঘটতে থাকবে। বেশ কিছু দেশের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছাচ্ছে যে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে সহনশীল ও উদার রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপিকে দুর্বল করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশকে, তাদের ভাষায়, ‘উগ্র রাজনীতির রণেেত্র’ পরিণত করা। ফলে নতুন নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনার ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে। এই দিক থেকে বিচার করলে আন্দোলন বিএনপির জন্য ইতিবাচক ত্রে তৈরি করেছে। এটা আমরা কমবেশি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।
যদিও এই লেখার শুরুতে বলেছি গণ-আন্দোলন সহিংস থাকবে নাকি অহিংস হবে তা মূলত নির্ভর করে মতাসীনদের আচরণের ওপর। অর্থাৎ খালেদার ভূমিকা সেকেন্ডারি। আর দমন-পীড়নে মতাসীনেরা যদি লাভের গুড় বেশি দেখে তবে গণ-আন্দোলনকে সহিংস দিকে তারাই ঠেলে দেবে। এই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে হাত-পা বেঁধে ঘরে বা জেলে রাখতে মতাসীনরা কুণ্ঠিত হবে না। আসলে এই পথে খালেদার সাফল্য নির্ভর করছে মূলত হাসিনার ওপর কূটনৈতিক মহলের চাপ সৃষ্টি করা এবং সেই চাপের সাফল্যের ওপর। তার অর্থ তাকে দ্রুত আরেকটি নির্বাচনে বাধ্য করা। এই সম্ভাবনার ওপর আস্থা রাখার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। এক কথায় বললে, পরাশক্তির ভাষায় বাংলাদেশকে ‘উগ্র রাজনীতির রণেেত্র পরিণত করার’ বিপদ ঠিক তাদের মতো করে দেখতে হাসিনাকে এখনো তারা রাজি করাতে পারেনি; এমনকি রাজি করানোর ধারেকাছেও যেতে পারেনি। ফলে এপথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সুরাহা হবে কি না এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। চূড়ান্তভাবে কী ধরনের চাপ পারাশক্তিগুলো শেখ হাসিনার ওপর প্রয়োগ করছে তার ওপর সেটা নির্ভর করবে।
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় যে জয় সেটা হচ্ছে একটি অসাম্প্রদায়িক ও লিবারেল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নস্যাৎ করে দেওয়া। আমার মনে হয়, খালেদা জিয়ার মতায় যাবার চেয়ে আওয়ামী রাজনীতির এই ভণ্ড দিকটি উন্মোচন আন্দোলনের বিশাল সাফল্য। আওয়ামী লীগের যে ভাবমূর্তি ছিল, খালেদা জিয়া তা দেশে-বিদেশে মারাত্মকভাবে ুণœ করতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক তাঁরা দলটিকে অসাম্প্রদায়িকতার জন্য সমর্থন করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যারা সমালোচক তারা দীর্ঘ দিন ধরেই বলে আসছে যে, আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক দল নয়। তাদের মুখে ফুলচন্দন দিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের সাম্প্রদায়িক চরিত্র এবার প্রকটভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে। নিজের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি উদ্ধার করা আওয়ামী লীগের জন্য খুবই কঠিন হবে। যেসব এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনার জায়গাগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এবারই প্রথম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদসহ যারা নিজেদের ‘সেকুলার জনগোষ্ঠী’ মনে করে, তারা দাঙ্গার জন্য প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগকেও দায়ী করেছে। এর দায় একতরফা ইসলামপন্থী দল ও বিএনপির ওপর চাপিয়ে দেবার প্রাণান্ত চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগ সফল হয়নি।
খালেদা জিয়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টানসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী ও নাগরিকদের সুরার কথা বারবার বলেছেন, কিন্তু তাকে কার্যকর করবার েেত্র তার জোটের প থেকে সুনির্দিষ্ট কোন পদপে ও তৎপরতা দেখা যায়নি। হতে পারে, সরকারি দমন-পীড়নের মুখে সেটা সম্ভব ছিল না। এই অজুহাত দেওয়াই যায়। কিন্তু দুর্বল ও অসহায় নাগরিকদের জান, মাল ও উপাসনার ত্রে এবং আক্রান্ত জনপদগুলোতে সরাসরি হাজির থেকে প্রাণ দিয়ে তাদের রা করার মধ্য দিয়েই বিএনপিসহ তার জোটের সদস্যরা বাংলাদেশের মর্যাদা অুণœ রাখতে সম হতে পারেন। এটাই একমাত্র পথ, কাগুজে ঘোষণা দিয়ে নয়। সাম্প্রদায়িকতাকে কোনভাবেই বরদাশনা করবার যে নীতির কথা খালেদা জিয়া বলেন, এবার তাকে যেকোন মূল্যে সেটা প্রমাণ করতে হবে।
তৃতীয়ত; আওয়ামী লীগ দিল্লির বশংবদ একটি রাজনৈতিক দল এই ভাবমূর্তি আরো গভীর হয়েছে। সাধারণ জনগণের বিশ্বাস অর্জন শেখ হাসিনার পে আগের চেয়েও তুলনামূলকভাবে কঠিন হবে। এ েেত্র কতিপয় গণমাধ্যমের নীতিনৈতিকতা-বিবর্জিত নির্লজ্জ মিথ্যাচার ও প্রপাগান্ডা কোন কাজে আসবে না। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নিরন্তর দমন-পীড়ন ছাড়া শেখ হাসিনার পে রাষ্ট্র পরিচালনা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠবে।
পাঁচ.
খালেদা জিয়ার সামনে দ্বিতীয় যে পথ খোলা আছে সেটা কঠিন। সেটা বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের পথ। সেই পথে তিনি অনেক দূর এসেছেন। আগামী দিনে কত দূর যাবেন এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তাঁকে ভেবে দেখতে হবে কূটনৈতিক মহল হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে নতুন নির্বাচনে বাধ্য করতে আদৌ সম হবার সম্ভাবনা আছে কি না। ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি হাসিনা এই ধরনের চাপের তোয়াক্কা করেন না। খালেদা জিয়াকে ভাবতে হবে শুধু বাইরের চাপে শেখ হাসিনার অবৈধ ও বেআইনি সরকার পরাস্ত হবে না। যদি হোত সেটা অনেক আগেই ঘটত। কূটনৈতিক মহলের ঘাড়ে বসে একটা নির্বাচন পাবার সম্ভাবনা আগের চেয়ে এখন হয়তো একটু বেশি। কিন্তু কূটনৈতিক সমর্থন তা নিশ্চিত করবার জন্য যথেষ্ট নয়। খালেদা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলেও রক্তয়ী সংগ্রাম ছাড়া তা আদায় করা সম্ভব কি না, তা নিয়েও ঘোর সন্দেহ রয়ে গিয়েছে।
শেখ হাসিনা গণবিচ্ছিন্ন এবং মতায় থাকার বৈধতা তাঁর নাইÑ এর সবই সত্য। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে বুঝতে হবে, শেখ হাসিনা নন, তাঁকে কার্যত লড়তে হচ্ছে দিল্লির বিরুদ্ধে। বিশেষভাবে দিল্লির দণি এশীয় রণনীতির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বাস্তবতাই আজ নির্ধারক শর্ত। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনরত জনগণের সঙ্গে তিনি কত দূর যাবেন সেই সিদ্ধান্ত তাঁর।
ইতিহাসের সদর রাস্তায় সবাই হাঁটবার হিম্মত রাখেন না। তাঁদের সংখ্যা স্বল্পই হয়। খালেদা জিয়া নিজেকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করবেন কি না, সেটা একান্তই তাঁর নিজের। দেখা যাক ভবিষ্যৎ আমাদেরকে কী দেখাতে পারে!
১৮ জানুয়ারি ২০১৪। ৫ মাঘ ১৪২০। আরশিনগর।
Daily Naya Diganta