Dedicated to the Shabhag Mob! LOL
অরণ্যে রোদন
কী সুন্দর! কী শান্তিপূর্ণ!
আনিসুল হক | তারিখ: ১৯-০২-২০১৩
তরুণদের আন্দোলনের সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ। আগাগোড়া তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ আর অহিংস। তারা শাহবাগ চত্বরে সমবেত হয়েছিল প্রতিবাদ জানাতে। অল্প কয়েকজনই সমবেত হয়েছিল প্রথম বিকেলে, ধীরে ধীরে সেখানে সমবেত হতে থাকে লাখ লাখ মানুষ। সেই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে সারা দেশে, এমনকি সারা বিশ্বে। যেটা লক্ষ করার মতো, তারা একটা ঢিলও মারেনি, একটা গাড়িরও কাচ ভাঙেনি, কোথাও কাউকে আঘাত করেনি, কোথাও আগুন জ্বালেনি। যা কিছু কষ্ট তারা নিজেরা করছে। যা কিছু আঘাত তারা নিজের বুক পেতে গ্রহণ করছে। কিন্তু পাল্টা আঘাত তারা করতে যায়নি। অথচ উসকানি আসছে বিপরীত পক্ষ থেকে।
কী যে সৃজনশীল একেকটা কর্মসূচি তারা গ্রহণ করছে। তারা বলল, তিন মিনিটের জন্য নীরব থাকুন, যে যেখানে পারেন। অফিস-আদালত-হাটবাজার থেকে লোকজন বেরিয়ে নেমে পড়ল রাস্তায়, সারা বাংলাদেশ নীরব হয়ে রইল তিন মিনিট। আমার ঘোরতর সন্দেহ ছিল এই কর্মসূচির সাফল্য নিয়ে। অতীতে আরও দু-একবার এ ধরনের প্রতীকী কর্মসূচি কেউ কেউ ঘোষণা করেছিলেন, সেসবে তেমন সাড়া মেলেনি। সন্দিগ্ধমনের সমস্ত সন্দেহ উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে ঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। এরপর বলা হলো, মোমবাতি জ্বালানো হবে।
আমার মনে আবারও সন্দেহ। এই কর্মসূচি কে পালন করতে যাবে? আমার মনের সমস্ত দ্বিধা পুড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশে জ্বলে উঠল লাখ লাখ মোমবাতি। যিনি রাস্তায় নামলেন না, তিনি জ্বালালেন তাঁর নিজের ঘরের কোণটিতে। কেউ বা বারান্দার রেলিংয়ের ওপর। কেউ বা জ্বালালেন রাস্তার ফুটপাতে। আর হাতে হাতে মোমবাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল লাখো মানুষ, সমাবেশে সমাবেশে। সেই মোমবাতির শিখা জ্বলছে, অন্ধকারে মনে হচ্ছিল আকাশ ভরা অনন্ত নক্ষত্রবীথি জ্বলছে, যেন জ্বলছে আমাদের ৩০ লাখ শহীদের অমর পবিত্র আত্মা। অভয়ের বার্তা রটে গেল সারা দেশে। মানুষের হূদয়ে হূদয়ে। এরপর আর কী সৃজনশীলতা দেখানো যাবে? আর কোনো অভূতপূর্ব কর্মসূচি ওরা নিতে পারবে? আমি লেখক, আমি নাট্যকার, আমাকে লেখার মধ্যে নতুন চরিত্র, নতুন ঘটনা, নতুন সংলাপ, নতুন উপমা, নতুন বিষয় প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরতে হয়। আমার মাথায় আর কোনো আইডিয়া তো আসছে না! তখন দেখলাম, ছেলেমেয়েরা আরেকটা কর্মসূচি ঘোষণা করল, সকাল ১০টায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় একযোগে পতাকা উত্তোলন আর জাতীয় সংগীত গাওয়া। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসিতরুণ গলায় এই অপরূপ গানের মূর্ছনায় ভরে উঠল বাংলার আকাশ-বাতাস।
রবীন্দ্রনাথের এই গানটির নিশ্চয়ই অন্য কোনো মানে আছে
এত দিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে/
বালকবীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়
এ কী গো বিস্ময়।
অবাক আমি তরুণ গলার গান শুনে/
সত্যি তরুণকণ্ঠের আহ্বান যেন আজ বিশ্ব জয় করল।
এই যে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, এই যে অহিংস কর্মসূচি, এই যে সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি পরিহার করা, এটাই আন্দোলনের শক্তি। শাসকেরা, অত্যাচারীরা, সন্ত্রাসীরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে। আপনি যদি লাখো মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ঘটাতে পারেন, আপনাকে হরতাল ডাকতে হয় না। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আট ফেব্রুয়ারি আর ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ দুই দিন সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষ হাজির হয়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যদি কোনো সমাবেশে এক লাখ মানুষ সমবেত করতে চায়, তাদের তিন মাস আগে থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করতে হয়। এক লাখ লোক সমবেত করার জন্য অন্তত দুই হাজার বাস বা ট্রাক তাদের লাগে। দুই হাজার বাসের প্রতিটির জন্য পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হলে এক কোটি টাকা শুধু বাসভাড়া দিতে হয়। বস্তি থেকে মানুষ ধরে আনার জন্যও মাথাপিছু টাকা গুনতে হয়। সেই সব ঢাকাদর্শী মানুষ জনসভায় নেমেই এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এ কারণে সমাবেশ না ডেকে হরতাল ডাকা হয়। কারণ, তাতে টাকাও খরচ হয় না, আর গায়েও খাটতে হয় না। একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দিলেই হলো।
আর দেখুন শাহবাগের শুক্রবারের সমাবেশগুলো। কাউকে ভাড়া করে আনতে হয়নি। কাউকে বাসে তুলতে হয়নি। তিন মাসের শিশুকে কোলে করে চলে এসেছে পুরো পরিবার, তেমনি ৮০ বছরের বৃদ্ধ এসেছেন বগলে ক্র্যাচ নিয়ে। ভিখারি তাঁর ভিক্ষে করে উপার্জিত ৩০০ টাকা দান করে দিয়েছেন। পাউরুটিওয়ালা যখন শুনেছেন এই রুটি যাবে শাহবাগে, তিনি দাম নিয়েছেন অর্ধেক। এ তো মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোকেই যেন ফিরিয়ে আনল। আগুনের পরশমণি ছোঁয়ানো দিন।
শাহবাগের তরুণেরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে সৃজনশীলতা আর সৌন্দর্যেরও অপূর্ব উদাহরণ সৃষ্টি করে চলেছে।
অহিংস কর্মসূচি দিয়ে মহাত্মা গান্ধী ভারত স্বাধীন করতে পেরেছিলেন। মার্টিন লুথার কিং একই কর্মসূচি দিয়ে আমেরিকায় কালো মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে পেরেছেন। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের কাছে ইসলাম মানে শান্তি। ধর্মের নামে উগ্রতা, মানুষ হত্যা, হানাহানি এ দেশের মানুষ কোনো দিনও সমর্থন করেনি। এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের কোনো না কোনো শাস্তি চায়।
কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে গৃহযুদ্ধের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলছেন, দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের উসকানির মুখে বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। আর তারা তাতে ফুল মার্কস পাচ্ছে। তাদের যখন বলা হলো, স্লোগানে সহিংস শব্দগুলো ভালো শোনায় না, তারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্লোগানের ভাষা পরিমার্জনা করল। তাদের একজন সহযোদ্ধাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, এতে তারা ক্ষুব্ধ, শোকার্ত, কিন্তু তাই বলে দাঁতের বদলে দাঁত নীতি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েনি। এখানেই তাদের জয়ের সূত্রখানি নিহিত। তারা জানে, এই গৃহটা আমাদের। এই গৃহে যুদ্ধ তারা বাধাতে চায়, যারা এই গৃহটাকে নিজের গৃহ মনে করেনি।
যাদের ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নয়। যারা এই দেশটার জন্মটাকেই মেনে নিতে পারেনি। এ দেশের জন্মের বিরোধিতা করেছে যারা। যারা এ দেশের সংবিধান-আইন-কানুন মানে না। যারা এ দেশের পুলিশকে নিজের পুলিশ মনে করে না, তাদের গৃহযুদ্ধের উসকানিতে কেন আমরা পা দেব? আমাদের রাষ্ট্র আছে, যা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি। সেই রাষ্ট্রের নিয়মকানুন আছে, সংবিধান আছে। যারা আইন ভঙ্গ করছে, তাদের আমরা আইনের হাতে তুলে দেব। দেশে অশান্তি, হানাহানি হোক, এটা কেন দেশপ্রেমিক তরুণেরা চাইবে? আর যারা সহিংস সশস্ত্র আক্রমণের পথ নিয়েছে, দেশের মানুষ তাদের আরও বর্জন করবে। তারা বিলুপ্ত হয়ে যেতে বাধ্য।
বাংলাদেশটাকে উন্নতির মহাসড়কে তুলে দিয়েছে এ দেশের তরুণেরা। এরা এভারেস্টে উঠছে। এরা পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডার ক্রিকেটারের গৌরব অর্জন করছে। এরা মাছের চাষ, পোলট্রি, সবজির চাষ করে দেশে বিপ্লবের জোয়ার এনেছে। এরা নতুন নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে পাঠাচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। এরা তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব সংঘটিত করছে। সিআইএর কাগজ যেটা দেওয়া হয়েছে পুনর্নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ওবামাকে, সেখানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ইউরোপকে ছাড়িয়ে যাবে। এ ধরনের অনেক খবর বিদেশি অর্থনৈতিক কাগজগুলোতে ছাপা হচ্ছে, রব উঠে গেছে, বাংলাদেশ আসছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন শুনতে পাচ্ছে পুরো বিশ্ব।
হিসাবটা তো খুব সহজ। এটা একটা গাণিতিক বাস্তবতা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগ তরুণ। ৯৮ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। লাখ লাখ তরুণ প্রতিবছর স্কুল থেকে বের হয়ে আসছে। মধ্যবিত্ত বড় হয়ে গেছে। ২০ বছর পরে যে কৃষিক্ষেত্রে কাজ করবে, সে-ও শিক্ষিত। যে গাড়ি চালাবে, সে-ও শিক্ষিত। এ দেশের উন্নতি না হয়েই পারে না। প্রতিদিন তিন হাজার শ্রমিক কাজের সন্ধানে বিদেশে যায়। এরা ভবিষ্যতে যাবে দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে। এখন প্রায় ৯০ লাখ মানুষ বিদেশে, ২০ বছর পর এই সংখ্যা এখনকার হিসাবেই তিন কোটি হয়, কিন্তু আসলে আরও বেশি মানুষের বিদেশে যাওয়ার কথা। তারা দেশে টাকা পাঠাবে। তার মানে, ২০ বছর পরের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে একটা উন্নত দেশ হবেই। এতে কোনো ভুল নেই। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর অর্থনৈতিক উন্নতি হলে, অর্থনীতিবিদ মুশতাক খানের তত্ত্বমতে, সুশাসন, দুর্নীতিমুক্তি, আইনের শাসনও আমরা পাব।
এ রকম একটা সম্ভাবনাময় দেশের সম্ভাবনার পথে অন্তরায় হওয়ার জন্য গৃহযুদ্ধের হুমকি তারাই দেখাবে, এই দেশটাকে যারা নিজেদের গৃহ মনে করে না। তাদের পাতা ফাঁদে এ দেশের সচেতন তরুণ সমাজ পা দিচ্ছে না। তারা শান্তির নীতি গ্রহণ করেছে। তারা অহিংসার পথে সুন্দর সুন্দর কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। এই তরুণদের অভিবাদন।
রাস্তার স্লোগান শাব্দিক অর্থে নেওয়ারও দরকার নেই। আমরা যখন বলতাম, ভুট্টোর পেটে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করোতার মানে এই নয়, সত্যি সত্যি ভুট্টোর পেটে লাথিই মারা হয়েছিল। তবু স্লোগানগুলো, স্ট্যাটাসগুলো যদি সুন্দর হয়, বাচ্চারা তা থেকে মানবতাবোধ, সৌন্দর্যবোধের শিক্ষা অর্জন করতে পারবে।
আমাদের তরুণেরা, শাহবাগের নতুন প্রজন্ম, সারা দেশের তরুণেরা আমাদের শান্তির সৌন্দর্য ও শক্তির শিক্ষা দিয়ে চলেছে। আমরা পুরোনোরা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
à¦à§ সà§à¦¨à§à¦¦à¦°! à¦à§ শানà§à¦¤à¦¿à¦ªà§à¦°à§à¦£! - পà§à¦°à¦¥à¦® à¦à¦²à§