ইসলামপন্থিদের উত্থানে কূটনৈতিক গুরুত্ব বাড়ছে আরবদের
ঢাকা (আরটিএনএন
: বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামপন্থি শক্তিগুলোর অভূতপূর্ব উত্থান ঘটেছে। রাজনীতির ময়দানে তাদের গুরুত্ব দিতে হচ্ছে সরকারি ও বিরোধী উভয় জোটকেই। দেশে জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে প্রবল রাজনৈতিক বিভক্তির এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মুসলিম প্রধান আরব দেশগুলোর কূটনৈতিক তৎপরতা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে দেশে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে এসব দেশের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ করছেন কেউ কেউ। তারা এও বলছেন যে, জাতীয় রাজনীতিতে এভাবে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত এবং তা কাম্য নয়।
বৃহস্পতিবার আরটিএনএনের সঙ্গে আলাপে এসব কথা বলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতির তিন বিশ্লেষক।
বাংলাদেশে নিযুক্ত আরব দেশগুলোর কূটনীতিকরা এখানকার চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন তারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশা করেন। গতকাল বুধবার তারা বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এই কথা বলেন। পরে জানা যায়, একই আশাবাদের কথা তারা সরকারকেও জানানোর পরিকল্পনা করেছেন।
এবিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বললেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরব দেশগুলোর কূটনৈতিক তৎপরতার ইতিহাস ছিলো একটু ভিন্ন। অতীতে তারা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে কখনো কথা বলেনি। এবার তারা সক্রিয় অবস্থানে রয়েছে। আমাদের বিরোধী ও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। এটা নতুন ব্যাপার।
আরব দেশগুলোর এই সংগঠিত কূটনৈতিক উদ্যোগ সম্পর্কে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বললেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থিরা এখন যেকেনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এদের সাথে আরব দেশগুলোর সুসম্পর্ক থাকায় এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আরব কূটনীতিকরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের এই অধ্যাপক মনে করেন, দেশের প্রধান দুটি দলই ইসলামপন্থিদের সাথে রাখতে চায়।
তিনি বললেন, বিরোধীদল বিএনপি জোট করেছে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের সাথেও রয়েছে কয়েকটি ইসলামপন্থি দলের সুসম্পর্ক। এছাড়া নতুন করে হেফাজতে ইসলাম এখন আলোচনায় এসেছে। তারাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রাজনীতিতে।
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ইসলাম ও রাজনীতির নানা বিষয়ে বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের সাথে আরব দেশগুলোর শাসকশ্রেণীর নানা পরস্পর বিরোধী অবস্থান থাকলেও সবমিলিয়ে তারা আবার একই মেরুতে অবস্থান করছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই বিশ্লেষক মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেই অস্থিরতা ও সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে আরব দেশগুলো বেশ উদ্বিগ্ন। তাই তারা প্রধান বিরোধীদলের সঙ্গে আলোচনা করছেন। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেও তারা আলোচনা করতে পারেন।
জনাব ইমতিয়াজ এও বলেন যে আরব দেশগুলো এই দুই জোটের মাঝে সংলাপ বা আলোচনায় মূখ্য ভূমিকা রাখলে সেটা অস্বাভাবিক কিছু হবে না।
বেগম জিয়ার সঙ্গে আরব কূটনীতিকদের সঙ্গে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মোবিন চৌধুরী। তিনি আরটিএনএনকে বললেন, আরব দেশের কূটনীতিকরা তাদের নিজেদের আগ্রহেই বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। আমরা তাদের ডেকে আনিনি। এটা তাদের নিজস্ব কূটনীতির অংশ।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, মরক্কো, ইরাক, ফিলিস্তিন, লিবিয়া, মিশর, কাতার ও ওমানের কূটনীতিকরা। এতে নেতৃত্ব দেন কূটনৈতিক কোরের ডিন ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত শাহের মোহাম্মদ।
তবে যেকোনো হস্তক্ষেপমূলক তৎপরতার তীব্র বিরোধিতা করেন দার্শনিক ও রাজনীতি তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার। বর্তমান সংকটে সম্প্রতি নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটি গঠন করে আরো অনেকের সঙ্গে তৎপরতা চালিয়ে আসছেন তিনি।
ফরহাদ মজহার বললেন, আমরা সবসময় বাইরের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করি। একটা দেশের মর্যাদা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও আভ্যন্তরীন শৃঙ্খলার জন্য বিদেশীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা জরুরি।
তিনি বলেন, তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এটা তাদের কূটনৈতিক রীতির অংশ। তাদের উচিত হবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে একইভাবে তাদের উদ্বেগের কথা জানানো।
তবে জনাব ফরহাদ বলেন, দেশে কোন সংকট দেখা দিলে রাজনীতিবিদরা যেভাবে কূটনীতিক পাড়ায় দৌঁড়ে যান, তা নিন্দনীয়।
ইসলামপন্থিদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উপস্থিতি প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহার বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি প্রমাণ করলো, জামায়াতে ইসলামী-ই একমাত্র ইসলামপন্থি দল নয়। এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ইসলামের ব্যাপারে সংবেদনশীল।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই প্রথম ইসলামপন্থি পণ্ডিতগণ, মুফতিগণ টক শোতে অংশ নিচ্ছেন। তারা তাদের মতামত তুলে ধরছেন। দর্শক তা গ্রহণ বা বর্জন করছে। গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য এটা খুব জরুরি।
প্রত্যেকে তাদের মত প্রকাশ করবে। এটা গণতন্ত্র। এর বিরোধিতা করার মানে হলো আমরা গণতান্ত্রিক চর্চা করি না। আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে ইসলামের বিরোধিতা করা মানে প্রগতিশীলতা। এরপরও আমাদের গণমাধ্যমও এখন ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িতদের গুরুত্ব দিচ্ছে, বলেন এই রাজনীতি তাত্ত্বিক।
ফরহাদ মজহার বলেন, এদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এখানকার রাজনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক আন্দোলন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসলামের দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে, মূল প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারছি কি না?
একইভাবে অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বললেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যেই সংকট দেখা দিয়েছে- এটা শুধু আমাদের রাজনৈতিক সংকট। আমাদের নিজেদের বিষয়ে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ কূটনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সব সময় বলে আসছি, এসব সংকট রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা উচিত। অথচ অতীতের মতো এবারও আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বিদেশী শক্তির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
তিনি বলেন, এই সংকট সমাধনের পথে রাজনৈতিক জোটগুলোকে নিয়ে আসতে আরব দেশগুলো ছাড় আদায় করতে কতটা সামর্থ্য রাখে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে এসব দেশ যদি আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতকে নিয়ে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় তা সম্ভব হতেও পারে।