ভারতীয় চলচ্চিত্র বিতর্ক: দেশের হলে বিদেশী ছবি
:: পাভেল রহমান, বিভাগীয় সম্পাদক, বিনোদন ::
বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক হচ্ছে অনেকদিন ধরেই। ভারতীয় তিনটি ছবি মুক্তির মধ্য দিয়ে প্রায় চার দশক পর বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শন শুরু হয়েছিলো ২০১১ সালে ২৩ ডিসেম্বর। কলকাতার স্বপন সাহা পরিচালিত জিৎ, বর্ষা ও দিপঙ্কর দে অভিনীত 'জোর' ছবিটি মুক্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৭২ সালের পর বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে আবার শুরু হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শন। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প স্পষ্ট দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি, পরিচালক সমিতি ও শিল্পী সমিতিসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন শুরু থেকেই ভারতীয় ছবি আমদানি ও প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামে। অন্যদিকে ভারতীয় ছবির আমদানির পক্ষে দাঁড়ায় সিনেমা হল মালিকরা। এ বিষয়ে প্রদর্শকরা বলেন, দর্শকের অভাবে যেখানে একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভারতীয় ছবি আমদানি হলে আবার হলমুখো হবে দর্শক।
এদিকে নির্মাতা এবং শিল্পীদের অনেককেই দেখা যায় প্রকাশ্যে বিরোধীতা করতে। অনেকেই বিভিন্ন সভা সমাবেশে দাবী তুলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের অবাধ প্রদর্শন দেশের সেনেমা শিল্পকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। এ দাবীর মুখেই বিষয়টি আদালত পর্যন্ত। শেষে আদালতের রায়ে দেশের সিনেমা হলে প্রদর্শন করা হয় ভারতীয় ছবি। পরপর তিনটি ছবির প্রদর্শন হলেও ব্যবসায়ীকভাবে খুব একটা সফল হয়নি ছবিগুলো। ব্যবসায়ীক স্বার্থের কথা চিন্তা করে সিনেমা হল মালিকরা ভারতীয় ছবি আমদানীর পক্ষে দাঁড়ালেও সেই সিনেমা গ্রহণ করেনি দেশের সাধারণ দর্শক।
গত বছর দুই বাংলার চলচ্চিত্রের বাজার উন্মক্ত করে দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন। কলকাতার চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এসে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। আবার গোপন বৈঠকের খবরও শোনা যায়। কলকাতার প্রসেনজিৎ, জিৎ, গৌতম ঘোষসহ অনেককেই গোপনে বাংলাদেশে আসতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ সফরে আসার পর কলকাতার প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষ প্রতিমুহূর্তের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দাবী করেছিলেন দুই বাংলার চলচ্চিত্রের স্বার্থেই চলচ্চিত্র বিনিময় জরুরি। তিনি বলেছিলেন দুই বাংলার চলচ্চিত্রের একটাই জানালা হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দাবী করেছেন দুই বাংলার চলচ্চিত্রের বাজার উন্মক্ত করে দিলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প হুমকির মুখে পড়বে। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন নিজেদের অসুস্থ ঘোড়াকে নিয়ে রেস-এ নামাটা হবে আত্মঘাতী।
এই বিতর্কে নতুন করে জালানী সরবারহ করলেন নতুন সংষ্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনিও দুই বাংলার চলচ্চিত্র বিনিময়ের ব্যাপারে ইতিবাচক মতামত প্রকাশ করেছেন। এতে আবারও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে দেশের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।
তবে সাধারণ দর্শকরা চাইছে প্রকাশ্যে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হওক। বেশীরভাগ দর্শক মনে করছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখন কলকাতার ছবির সঙ্গে প্রতিযোগতিা করার মতো পর্যায়ে নেই। এ অবস্থায় চলচ্চিত্রের বাজার খুলে দিলে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য হবে আত্মঘাতী।
যে প্রক্রিয়ায় শুরু হয় ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী
দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থরক্ষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে উপমহাদেশীয় তথা ভারতীয় ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছিলেন। দীর্ঘ চার দশক পর ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় ছবি আমদানি ও প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে ভারতীয় ছবি আমদানি নীতিমালার বিধিনিষেধ তুলে নেয়। কিন্তু সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রবল আপত্তি জানায় দেশীয় চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী ও কলাকুশলীরা। ঢালিউডের নির্মাতা-শিল্পী-কলাকুশলীদের সম্মিলিত প্লাটফর্ম বাংলাদেশ চলচ্চিত্র একতা পরিষদ, সম্মিলিত নাগরিক জোটসহ বিভিন্ন সংগঠন সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করে। চলচ্চিত্র শিল্পী, কলাকুশলী ও নির্মাতাদের এই আপত্তির মুখে সরকার ভারতীয় ছবি আমদানির ওপর আবার বিধিনিষেধ আরোপ করে।
সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আমদানিকারক ও প্রদর্শকরা উচ্চ আদালতে রিট আবেদন জানান। 'জোর' ছবির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইনউইন এন্টারপ্রাইজ ও মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের পক্ষে হাইকোর্টে এই আবেদন পেশ করেন অ্যাডভোকেট এম আমিন উদ্দিন। এ রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি না করতে নির্দেশ দেয়।
আদালত তথ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি, পুলিশ কমিশনার এবং বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উদ্দেশেও এ বিষয়ে নোটিশ জারি করে। নোটিশে উল্লেখ করা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মনীতি মেনেই আমদানিকারকরা ভারতীয় ছবি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ আইনসম্মত নয়। আমদানিকৃত ছবি প্রদর্শনের বিষয়ে প্রদর্শক ও সিনেমা হলগুলোর প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও নির্দেশ দেয় আদালত।
আদালতের নির্দেশে উলি্লখিত সময় যেসব ছবি আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়, সেসব ছবিকে তথ্য মন্ত্রণালয় অনাপত্তি পত্র দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ২৩ ডিসেম্বর প্রায় চার দশক পর বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয় ভারতীয় চলচ্চিত্র। প্রথম দফায় 'জোর', 'বদলা' ও 'সংগ্রাম' নামে তিনটি ভারতীয় বাংলা ছবি প্রদর্শন করা হলে দর্শক ছবিগুলোকে তেমন গ্রহণ করেনি। এরপর 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে', 'কুচ কুচ হোতা হ্যায়', 'কাভি খুশি কাভি গাম', 'কাভি আলবিদা না কেহনা', 'মাই নেম ইজ খান', 'ওম শান্তি ওম', 'থ্রি ইডিয়টস' এর মতো আরো ৯টি হিন্দি ছবির ব্যাপারে অনাপত্তিপত্র থাকলেও সবগুলো ছবি দেশের সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়নি।
যে কারণে নিষিদ্ধ ছিল বিদেশী চলচ্চিত্র
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র মাধ্যমকে শক্তিশালী রূপে গড়ে তোলার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে বেশ তৎপর দেখা গিয়েছিল। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করে পৃথিবীর বিখ্যাত চলচ্চিত্রসমূহ থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র মাধ্যমকে পুনর্গঠন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই পরিল্পনার প্রাথমিক অংশ হিসেবে ভারত থেকে শিল্পসমৃদ্ধ ছবি আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ভারতের চলচ্চিত্র বিভাগ বাণিজ্যিক ছবি ব্যতীত শুধু শিল্পসমৃদ্ধ ছবি প্রদানে রাজি হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন মর্মাহত হয়ে স্থানীয় নির্মাতাদের সর্বোচ্চ মেধা প্রয়োগের মাধ্যমে চলচ্চিত্র শিল্পে আত্মনিয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ফলে দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থরক্ষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে উপমহাদেশীয় তথা ভারতীয় ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছিলেন।
ফিরে দেখা : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্ম পূর্ব পাকিস্তানে। পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৫৭ সালে তৎকালীন শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রাদেশিক পরিষদের সভায় ইপিএফডিসি বিল উত্থাপনের মধ্যদিয়ে এদেশে চলচ্চিত্র শিল্প এক প্রকারের সামাজিক মর্যাদা ও স্বীকৃতি লাভ করে। বিচ্ছিন্নভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বা বায়োস্কোপের প্রদর্শনী আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে, যা পরবর্তী সময়ে এফডিসি নির্মাণকে অনিবার্য করে তোলে। সাফল্য-ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে ৫৭ বছরের পথ অতিক্রম করছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র।
যদিও এদেশের মানুষের চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস ২০০ বছরের। ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে এদেশে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর শুরু হওয়ার পর ১৯০০ সালে হীরালাল সেন নির্মাণ করেন প্রথম চলচ্চিত্র। এরপর ১৯২৭-২৮ সালে নির্মিত হয় 'সুকুমারী' এবং 'দ্য লাস্ট কিস' (শেষ চুম্বন)। আবদুল জব্বার খাঁর 'মুখ ও মুখোশ' ছবির মধ্যদিয়েই নবযুগের সূচনা ঘটে। এরপর দীর্ঘ পথযাত্রায় নির্মিত হয়েছে প্রায় ৩ হাজারের মতো চলচ্চিত্র।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এর অধিকাংশ ছবিই চলচ্চিত্রের শিল্পমান বজায় রাখতে পারেনি। ফলে আমাদের চলচ্চিত্র বারবার উল্টোপথেই হেঁটেছে। চলচ্চিত্রের এই পশ্চাৎপদতার জন্য কেবলমাত্র চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট লোকদের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে আমরা কোনোভাবেই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না। স্বাধীনতার পর চার দশকেরও বেশী সময়ের পথচলায় অবহেলা আর সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে অনেকটাই অভিভাবকহীনভাবে বেড়ে উঠেছে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প।
১৯৭৫ সালের আগস্ট ট্রাজেডির পর একাধিক সামরিক শাসনামলে চলচ্চিত্র থেকে বাংলাদেশের সংস্কার ও সংস্কৃতিকে বনবাসে পাঠানো হয়েছিল। তানভীর মোকাম্মেলের ভাষায় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবিগুলোতে আরবি ঘোড়া আছে, ইরানি পোশাক আছে, টেক্সাসি পাহাড় আছে, নেই শুধু বাংলাদেশ।
শত জঞ্জাল আর আগাছার মাঝখানে কখনো কখনো গোলাপ ফুলের সুবাস আমরা ঠিকই পেয়েছি। এত সমস্যার মধ্যে থেকেও আমাদের নির্মাতারা নির্মাণ করেছেন 'ওরা এগার জন', 'ধীরে বহে মেঘনা', 'চাকা', 'দীপু নাম্বার টু', 'নদীর নাম মধুমতি', 'মুক্তির গান', 'মাটির ময়না'র মতো অনেক শিল্পসমৃদ্ধ ছবি।
আমাদের তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলাম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুসহ আরো অনেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাফল্য দেখিয়েছেন। স্বাধীনতার চার দশকের সাফল্য-ব্যর্থতার এরকম সমীকরণে দাঁড়িয়ে আমাদের চলচ্চিত্রকে নতুন রূপে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা না করে বিদেশি ছবি প্রদর্শনের বিষয়টি আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য কতোটা সুফল বয়ে আনবে এ বিতর্কে সাধারণ দর্শকেরও অংশগ্রহণ সৃষ্টি হওক। হুট করে কোন সিদ্ধান্ত যেন আমাদের চলচ্চিত্রের শিল্পকে ধ্বংস না করে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় : ১৭৫৫ ঘন্টা, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
ভারতীয় চলচ্চিত্র বিতর্ক: দেশের হলে বিদেশী ছবি