ARTICLE WRITTEN BY FAKHRUL ......
প্রিয় তরুণ প্রজন্ম
আজকের পৃথিবীর সদা-পরিবর্তনশীল টেকনোলজির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়াটা আমার প্রজন্মের মানুষদের জন্য কঠিন। আজকের তরুণদের কাছে ক্যালকুলেটর যেখানে প্রাগৈতিহাসিক টেকনোলজি, সেটা আমরা, আমি প্রথম চাক্ষুষ করেছি জীবনের ৩০ তম বছরে। সহস্র ব্যস্ততার মাঝে তবু চেষ্টা করি ফেসবুক, বাংলা ব্লগ ও অনলাইন পত্র-পত্রিকার পাঠক প্রতিক্রিয়ায় চোখ রাখার জন্য। ইন্টারনেটে পরিচয়হীনতার কারণে অংশগ্রহণকারীদের মন্তব্যগুলো সাবলীল ও নিঃসঙ্কোচ (অবশ্য চোখ-রাঙ্গানি দেখতে পাচ্ছি, ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে; ব্লগ লেখার জন্যেও মুচলেকা নিতে হয়েছে আসিফ মহিউদ্দিনকে
; বলাই বাহুল্য, বহু ক্ষেত্রেই তরুণরা আমাদের ওপর সদয় নন। সেটা বোধগম্য, সে বয়সে আমরাও ক্রোধকে উপলক্ষ করে খুঁজে ফিরেছি তারুণ্যের সারবত্তা। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাকে ভাবায়, ভীষণ ভাবায় – এজন্য নয় যে আমি রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট – বরং এজন্য যে ভাবনাটা আমার বয়সীদের জন্য পুরো নচ্ছাড়: আমাদের সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে, সেটা হবে তো?
আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি যে আজকের তরুণদের অনেকেই ক্রোধ আর হতাশার মাঝে খেই হারিয়ে ফেলছে। তারা যেন স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে। দেশের ঘুরে দাঁড়ানোর সাথে নিজের উন্নয়নের এক অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি করে তারা মনে করছে, দেশের উন্নয়নটা যেন অন্য কারো কর্তব্য, যার জন্য বরাদ্দ আছে বিশেষ একদল, তাদেরকে তাচ্ছিল্য করা যায়, দোষারোপ করা যায় কোনো পরীক্ষা ছাড়া, শুধু রাজনীতিবিদ বলে শনাক্ত করেই।
প্রিয় তরুণ প্রজন্ম: এ বাবদে আমার কিছু কথা বলার আছে আপনাদের, শুধুমাত্র একজন অগ্রজ হওয়ার দাবীতে। শুরু করতে চাই নিজের জীবন থেকে, একটু সহ্য করুন।
আজকে আপনাদের যে বয়স, সে বয়সেই আমরা পেয়েছিলাম নতুন একটা দেশ, আর পেয়েছিলাম নতুন কিছু স্বপ্ন, যে স্বপ্ন আমাদের আগের কোনও প্রজন্ম দেখতে পারে নি। মুক্তিযুদ্ধে আমরা অবশ্যই গিয়েছিলাম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য, কিন্তু মনে ছিল তার চাইতেও বড় একটা আশা: স্বাধীনতার সুফলটা আমরা সবাই ভাগ করে পৌঁছে যাবো উন্নতির দুয়ারে। আমরা কী রকম আশাহত হয়েছিলাম সে বয়ান আমার কাছে শুনলে আপনাদের মনে হতে পারে পক্ষপাতদুষ্ট, আপনার পাশের যে মানুষটা ৭২ থেকে ৭৫ এর সময়টাতে জীবিত ছিলেন, অতিবাহিত করেছেন তার যৌবন, তাকে একবার হলেও জিজ্ঞেস করুন।
সে টালমাটাল সময়ে আমি প্রবেশ করি চাকরি জীবনে, শিক্ষকতা পেশায়। আমার বন্ধুরা একের পর এক বিদেশে চলে যাচ্ছেন উচ্চ শিক্ষায়। পিএইচডি করে প্রবাসে থিতু হওয়ার চিন্তা যে আমার মাথায় আসে নি তা না। সে সময়টাতে আপনাদের চাইতে আমাদের জন্য উচ্চ শিক্ষার্থে পশ্চিমে যাওয়াটা বোধহয় একটু সহজই ছিল। তবু মনের কোণে কোথায় যেন একটা আশা ছিল, একটু চেষ্টা করে দেখি না কী হয়?
দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়, চলে আসি সরকারী চাকুরীতে। সেই চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে পুরোপুরি মনোনিবেশ করলাম রাজনীতিতে, যখন আমার বন্ধুরা ক্যারিয়ারের মধ্য-গগনে। মাঝ বয়সে এসে আমি রাজনীতি শুরু করলাম একদম প্রথম সিঁড়িটায় পা রেখে, ঠাকুরগাঁও পৌরসভা নির্বাচন করে (অবশ্য ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছি সক্রিয়ভাবে, সেটা ৬০ এর দশকের কথা
। যে কোন বিচারেই Bad Career Move. ’৮৯ সালে আমার সামনে স্বভাবতই এমপি, মন্ত্রী কিংবা বিএনপির বড় পদ পাওয়ার সম্ভাবনা অথবা আশা, কোনোটাই ছিল না। তবে একটা আশা অবশ্যই ছিল: দেখি না একটু ধাক্কা মেরে, কতটুকু যাওয়া যায়।
আপনাদের কি মনে হয় সে সময়টা ছিল প্রত্যয়দীপ্ত হয়ে আগুনকে স্পর্শ করে অসীমকে জয় করার দিন? মোটেও না, আজকের মতো না হলেও সেদিনও সন্ত্রাস ছিল, পেছনের দরজার রাজনীতি ছিল। আপনাদের মতো আমিও সেদিন চিন্তিত ছিলাম, ক্রোধে জর্জরিত হয়েছিলাম। প্রায় তের বছর আমি রাজনীতির জন্য পড়ে থেকেছি ঠাকুরগাঁয়ে, আমার পরিবার তখন ঢাকায়। আমার ছোট্ট দুটি মেয়ে শৈশব থেকে কৈশোর পার হয়ে তারুণ্য স্পর্শ করছে, আমি থাকছি দূরে, তাদের সময় দিতে পারি না। একজন পিতার জন্য কী কষ্টের এই বন্দোবস্ত সেটা বলে বোঝানো সম্ভব না। আমিও ভেঙ্গে পড়েছি বহু সময়ে, সম্মুখীন হয়েছি দ্বিধা ও প্রশ্নের। বহু সহকর্মীর অনৈতিকতা আমার মাঝে বিবমিষা জাগিয়েছে, বীতশ্রদ্ধ হয়েছি আর দশ জনের মতই। কিন্তু আশা হারাই নি। আমার বয়স এখন ৬৩; আমি যদি এ বয়সেও দেশটা ঘুরে দাঁড়াবে – এই স্বপ্ন দেখতে পারি, আপনারা কেন পারবেন না?
প্রিয় তরুণ প্রজন্ম: আমাদের প্রজন্মের ব্যর্থতা অনেক। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমাদের অনগ্রসর মনোভাব ও রাষ্ট্র পরিচালনায় পেশাদারিত্ব ও মহানুভবতার অভাবে এ দেশ তার কাঙ্ক্ষিত উন্নতি অর্জন করতে পারে নি। কিন্তু আমরা আপনাদের জন্য অন্তত এনে দিয়েছি স্বাধীনতা, যেটি অর্জনের জন্য একেকটি জাতিকে শত শত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আপনারা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। এর গুরুত্ব ও অপার সম্ভাবনা উপলব্ধি করুন। স্বাধীনতার মানে যা ইচ্ছে তাই করা না কিংবা যাকে ইচ্ছে তাকে ভোট দেয়াও নয়। বরং বেছে নেয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য আপনার যে আজীবন প্রচেষ্টা সেটাই স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ। আজ সময় এসেছে নিজেকে প্রশ্ন করার – যে তথ্য, শ্রম, অর্থ ও কাণ্ডজ্ঞান সহযোগে আমরা একটা মোবাইল ফোন কিংবা কম্পিউটার বেছে নেই, সে প্রেরণা ও প্রজ্ঞা আমাদের রাষ্ট্রভাবনায় বরাদ্দ আছে কি না?
আমি নিঃসঙ্কোচে জানাতে চাই যে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল দেশকে বদলাতে পারবে না, পারবেন আপনারা। আমার দাবী শুধু এতোটুকু যে বিএনপি এ মহাযজ্ঞে আপনার ও দেশের জন্য একটি বেটার প্ল্যাটফর্ম। কথাটা বলছি শস্তা বিরোধিতার জন্য না, দুটো দলের চরিত্র বিশ্লেষণ করে; আর সেজন্য আপনাদের কাছে আমি সমর্থন আশা করছি না, করছি অবজেক্টিভ থিঙ্কিং। বিএনপি কোন অতীতমুখী দল নয়, তাদের মনোজগৎ অতীতে অবরুদ্ধ নয়। অতীতের অর্জন আর ট্রাজেডি নিয়ে মানুষের সহানুভূতি আর অনুকম্পা আশা করে না বিএনপি। বিএনপি শুরু থেকেই একটি ভবিষ্যতমুখী দল। পৃথিবীতে এমন কোনও জাতি নেই যার অতীত রক্ত-রঞ্জিত নয় কিংবা পাপবর্জিত । তারা তাদের অতীত বেদনাকে ভুলে থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়, প্রতি নিয়ত অতীত ক্ষতকে সজীব করার রাজনীতি করে না। নাৎজি উত্থান-পর্ব (যেটা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ছিলো!) নিয়ে জার্মানরা রাজনীতি করে না, অস্ট্রেলীয় আদিবাসীরা তাদের উপর সংঘটিত অবিচার নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা করে নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করে না। আমাদের রাষ্ট্রের ইতিহাস অন্যান্য আর দশটি রাষ্ট্রের মতোই ভুলে ভরা। আমাদের প্রজন্মের বহু লোক ভুলের এই ফিরিস্তি নিয়ে আলোচনা করাকে তাদের জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছে। দয়া করে আপনারা এই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবেন না। আমরা এগিয়ে যেতে চাই, এগিয়ে যেতে চাই আমাদের অন্ধকার অতীতকে ভুলে গিয়ে নয়, ভুলে থেকে। এই এগিয়ে যাওয়ায় বিএনপি আপনার সামনে নয়, সাথে থাকতে চায়, কেননা চারিত্রিকভাবে বিএনপি একটা Inclusive দল আর আওয়ামী লীগ হোল Exclusive দল। তাদের রাজনীতি ধর্মাচারের নিকটবর্তী।
অন্যদিকে বিএনপি চায় সকল মতের সম্মিলন, শুধুমাত্র একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে – বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে দেশের উন্নয়নে অংশ নেয়া। আপনাদের কি মনে হয় রাজনৈতিক দল হিসেবে সেটা আমাদের জন্য সহজ একটা কাজ – মোটেও না। বিভিন্ন মতের মানুষকে এক প্ল্যাটফর্মে আনা কতটুকু কঠিন সেটা খালেদা জিয়াকে করুন, সাত খণ্ডে বই লিখে উত্তর দেবেন। তবু আমরা এ লক্ষ্যে অবিচল থাকবো; সুবিধাবাদিতার জন্য না, কাণ্ডজ্ঞানের জন্য। বৈচিত্র্য অব
বচ, সময়ই বলে দেবে। আমরা সময়ের সাথে নিজেদের বদলাতে চাই; যে-জন্য বিএনপির রাজনীতি সাস্টেইনেবল, আওয়ামী লীগেরটা না।
আমরা রাজনীতিবিদরা দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয়তাবোধ কথাগুলোকে অনেক সময়েই পাঞ্চ লাইন হিসেবে ব্যবহার করি; সবসময় খারাপ উদ্দেশ্যে করি, তা না। কিন্তু একবার নিজেকে সততার সাথে প্রশ্ন করুন তো দৈনন্দিন জীবনে কতবার আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা জাতীয়তাবাদের কথা সাগ্রহে চিন্তা করেন? চার ঘণ্টা ব্যয় করে অফিস যাওয়া আসার সময়, দশ ঘন্টার লোডশেডিঙে নেতিয়ে পড়ার সময়ে কিংবা চোখের সামনে কাউকে পিটিয়ে মারার দৃশ্য দেখার সময় কি আপনি অতীতের অর্জন নিয়ে উদ্বেলিত হন না বর্তমানের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠেন? আমাদের রাজনীতি এই বর্তমানকে ঘিরে এবং আমি নিঃসন্দেহে দাবী করতে পারি যে আমরা আওয়ামী লীগের চেয়ে বেটার ম্যানেজারস।
আপনাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের জিজ্ঞেস করুন, তাদের জীবনে, এমন কি পাকিস্তান আমলেও সরকারী ব্যবস্থাপনার এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তারা প্রত্যক্ষ করেছেন কি না? বাংলাদেশের বর্তমান সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা কোনও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সাথে তুলনীয়, দু-দুবার শেয়ার মার্কেট লুণ্ঠনে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত, সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণের কারণে মেধাবী তরুণদের মামা-চাচা ছাড়া চাকুরী পাওয়া আজ এক অসম্ভব ব্যাপার, রাষ্ট্রের যেখানে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা সেখানে সাধারণ নাগরিকদের ট্যাক্সে পোষা পুলিশ বাহিনীর অত্যাচারে বিরোধী দলীয় নেতাদের তো বটেই, সাধারণ নাগরিকদেরও মৃত্যু ঘটছে; সেই সাথে আছে দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি। আমি দাবী করি না যে আমাদের সময়ে বাংলাদেশ এক মধুময় দেশ ছিলো, ছিলো না কোনও সমস্যা। কিন্তু সততার সাথে নিজেকে প্রশ্ন করুন তো, ২০০৫ সালে আপনার পরিপার্শ্ব ও ব্যক্তিগত অবস্থা ভালো ছিলো, না আজ ভালো?
বলা হয়ে থাকে যে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে বার্মায় কারাবাসে প্রেরণ করার সময়ে কেবলমাত্র একটি প্রধান খাদ্য নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। তার পাচক বেছে নিয়েছিলো ছোলা। অবশিষ্ট কারাজীবনে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফরকে তার পাচক একটি ডিশ নাকি কখনো দ্বিতীয়বার পরিবেশন করেন নি। এটাই হোল ম্যানেজমেন্ট। সেটা না থাকলে অবস্থা কী হয় তার প্রমাণ মিলবে যোগাযোগ ও অর্থ মন্ত্রীর পারফর্মেন্সে। জনৈক বাংলাদেশী তরুণের ফেসবুক স্ট্যাটাস আনা হয়েছিলো আমার নজরে, মোক্ষম কিনা সে পর্যবেক্ষণ, আপনারাই পরখ করুন: এই আবুল বলে ঐ আবুলের দোষ, ঐ আবুল বলে এই আবুলের দোষ – আবুল-বাবুলে দেশটা শেষ।
হ্যাঁ, আমি বুঝি যে পরিস্থিতি খুব আশাব্যঞ্জক না। মাথার ওপর ভর করে আছে পাহাড়সমান সঙ্কট অথচ সরকার পড়ে আছে “অতীতসঠিককরণ” প্রকল্পে। তবু আমি অনুরোধ করবো, আশাহত হবেন না। জীবনের কঠিনতম মুহূর্তে যে তার আশার সাথে আপোষ করে না সেই বিজয়ী। কালের পরিক্রমায় আমাদের রাজনীতি যদি কখনো আপনাদের কাছে সেকেলে হয়ে পড়ে, তাহলে সেটাকে বদলে দিয়ে দেশটাকে সামনে নিয়ে যাবেন। আমরা অবশ্যই মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো। মনে রাখবেন কোনো মহাপুরুষ, ত্রাতা কিংবা শক্তিধর রাষ্ট্র আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। আমাদের সঙ্কট আমাদেরকেই কাটিয়ে উঠতে হবে। আপনার রাজনৈতিক দল বিএনপি এই মহান যাত্রায় কখনো হতোদ্যম হবে না, এই অঙ্গীকার করছি।
বিএনপি আপনার দল, এর দরজা আপনার জন্য খোলা আছে। আসুন এবং একে বদলে দিন আপনার সময়ের উপযোগী করে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর: বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব।