বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় গড়ে উঠেছে ফেনসিডিল তৈরির ৩২টি কারখানা। এসব কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল চোরাই পথে বাংলাদেশে এসে ছড়িয়ে পড়ছে। গত মার্চে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে বিডিআরের পক্ষ থেকে এসব কারখানার একটি তালিকা বিএসএফের হাতে তুলে দিয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়।
বিডিআর সূত্র জানায়, এসব কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল সীমান্ত দিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চারঘাট, ইউসুফপুর, মীরগঞ্জ, বাঘা, নাটোরের লালপুর, যশোরের শার্শা, ঝিকরগাছা, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া হয়ে রাজধানীতে ঢুকছে।
জানতে চাইলে বিডিআরের উপমহাপরিচালক (ডিডিজি
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. ওবাইদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ফেনসিডিল কারখানার তালিকা দিয়ে বিএসএফকে সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি। কারখানাগুলো বন্ধ হলে ফেনসিডিল পাচার অনেক কমে যাবে।’
তবে যোগাযোগ করা হলে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় নিষিদ্ধ ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক পাচারের বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশের একটি যৌথ ইশতেহারে সই করেন। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে মাদক পাচার নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় দুই দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারকেও সই করে। এ ছাড়া সার্কভুক্ত দেশগুলোর মাদক অপরাধসংক্রান্ত তথ্যবিনিময় ডেস্কের সঙ্গে এসব তথ্য আদান-প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু তার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
ফেনসিডিল পাচার নিয়ে ১ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সংসদে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় মাদক পাচার প্রতিরোধ কার্যক্রম চালাতে দুই দেশ একমত হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে দুই দেশ মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে। গত ৭ থেকে ১২ মার্চ দিল্লিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ ফেনসিডিল কারখানার একটি তালিকা বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সীমান্তে গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে ওপারের ফেনসিডিলের কারখানা শনাক্ত করা হচ্ছে।
৩২ কারখানা: বিডিআর সূত্র জানায়, বহুজাতিক একটি কোম্পানির তৈরি ফেনসিডিলই একসময় শুধু বাংলাদেশে আসত। কিন্তু বাংলাদেশের বাজার দেখে ভারতের বৈধ-অবৈধ অনেক প্রতিষ্ঠানই ফেনসিডিল তৈরি করতে শুরু করে। এখন ১০-১২টি কোম্পানির উৎপাদিত ফেনসিডিল নিয়মিত আসছে।
বিডিআরের পক্ষ থেকে ফেনসিডিল কারখানার যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তার বেশির ভাগই সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে। তবে সীমান্ত থেকে শত শত কিলোমিটার দূরের কারখানা থেকেও ফেনসিডিল বাংলাদেশে আসছে। তালিকার মধ্যে উত্তর চব্বিশ পরগনার কোটিয়াবাড়ী গ্রামে ইদ্রিস আলী কারখানার নাম রয়েছে। এ কারখানায় তৈরি ফেনসিডিল ভারতের লক্ষ্মীদাড়ি, দাঁতভাঙা বিল হয়ে সাতক্ষীরার ভোমরা এলাকায় আসছে। একই জেলার ইটিন্ডা বাজারে নারায়ণ সেনের কারখানার ফেনসিডিল ঘোড়াডাঙ্গা বিল হয়ে ভোমরা সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে। হিমাচল প্রদেশের পরিমল হেলথ কেয়ারের ও মুর্শিদাবাদের লালগোলার একটি কারখানার তৈরি ফেনসিডিল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। একই সীমান্ত দিয়ে আসছে বহরমপুরের তিনটি কারখানার ফেনসিডিলি। মালদার ইংলিশ বাজারের হিলু সরদার একাই পাঁচটি কারখানার মালিক। এ কারখানাগুলো ইংলিশ বাজার, মালদা সদর, জহুরকান্দো, মুর্শিদাবাদ ও পাকুড়ায় অবস্থিত। এসব কারখানার ফেনসিডিল ভারতের মুলাদিপুর, সাহিলাপুর, লালগোলা হয়ে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের বয়গ্রামের বিপ্লবের কারখানার পণ্য আসছে নৌপথে ভুটিয়াপাড়া, মংলা ও বাসুদেবপুর হয়ে। কোচবিহারের হাসপাতাল মোড়, বালিঘাটপাড়া ও বাংলাবাজারে প্রকাশ মাড়োয়ারি, হাবুল-বাবুল ও বিজয় ঘোষের তৈরি পণ্য আসছে হিলি, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের সীমান্ত দিয়ে। সাতক্ষীরার ওপারের শাকরা, ভোমরা ও কাকডাঙ্গা এলাকায় কারখানা গড়ে তুলেছেন নিতাই দাস। বেনাপোলের ওপারের বনগাঁও পুরান বাজার ও চাঁদপাড়া এলাকায়, সাতক্ষীরার উল্টোদিকে দেবহাটা, শাকরা ও পদ্মশাকরা এলাকায় গোপাল দাস, সঞ্চয় দাস, মন্তু দাস, রমেশ, বিষ্ণু ও তাতাই ফেনসিডিল কারখানা স্থাপন করেছেন। আখাউড়ার ওপারে ত্রিপুরার আমজাদ নগরে নেপাল চন্দ্র ঘোষ ও সুকুমার দেবনাথ, বিশালগড়ে রতন বাবু ও অমিত চক্রবর্তী ফেনসিডিল তৈরির কারখানা স্থাপন করেছেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা বিভাগের তথ্যমতে, সীমান্ত পথে ফেনসিডিল আসার পর রাজধানীতে পাঁচ শতাধিক স্থানে ফেনসিডিলের কেনাবেচা চলছে। মোহাম্মদপুর এলাকায় ৫৩টি, ধানমন্ডিতে ৩৩, মিরপুরে ৪০, ডেমরায় ৪০, মতিঝিলে ৪৫, সবুজবাগে ৬০, উত্তরায় ২৫, কোতোয়ালিতে ৪৫, লালবাগে ৩৩, সূত্রাপুরে ৩৯, রমনায় ৪০, তেজগাঁওয়ে ২৩, গুলশানে ২৭ ও খিলগাঁওয়ে ৫২টি স্থানে মাদক কেনাবেচা হচ্ছে।
জানতে চাইলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (মহাপরিচালকের দায়িত্বে
মো. ইউছুফ আলী প্রথম আলোকে জানান, মাদকদ্রব্য উদ্ধারে ৭ এপ্রিল বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে সভা হয়েছে। এতে মাদক উদ্ধারে রাজধানীতে একযোগে বড় ধরনের অভিযানের পরিকল্পনা হয়েছে। তবে অভিযানের দিনক্ষণ গোপন রাখা হয়েছে।
মামলা: পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজধানীতে মাদকদ্রব্য বিক্রি ও উদ্ধারের ঘটনায় প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১০০টি করে মামলা হচ্ছে। ২০০৯ সালে মাদকদ্রব্য আইনে সারা দেশে ২৪ হাজার ২৬৮টি মামলা হয়েছে। ২০০৭ সালে মামলা হয়েছিল ১৫ হাজার ৪৭৯টি। তবে এসব মামলায় আসামিদের সাজার হার খুবই কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধ প্রমাণিত হয় না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, এ বছরের দুই মাসে বিভিন্ন অভিযানে সাড়ে সাত হাজার বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ২০৯টি। ২০০৮ সালে উদ্ধার করা হয় ৫২ হাজার ৮৮৯ বোতল ফেনসিডিল, মামলা হয়েছে এক হাজার ২৫২টি। এভাবে প্রতিবছরই মামলা ও ফেনসিডিল উদ্ধারের সংখ্যা বাড়ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক বলেন, মাদকের মূল বাজার হলো রাজধানী। পুলিশ এখন মাদক উদ্ধারে বেশি জোর দিয়েছে। এ কারণে মাদকের মামলার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
অভিমত: মাদক নিরাময়ের সঙ্গে যুক্ত সংস্থা আপন-এর পরিচালক ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বর্তমানে ফেনসিডিল মাদকাসক্তের সংখ্যা বেশি। এদের বেশির ভাগই রাজধানীর বাসিন্দা। আগে হেরোইনে আসক্তের সংখ্যা বেশি ছিল; এখন ইয়াবা ও ফেনসিডিলে আসক্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এসব মাদক বেশি আসছে বলে আসক্ত ব্যক্তিরা সেদিকে ঝুঁকে পড়ছে।