হে পাঠকবৃন্দ, আপনার শুনিয়া পুলকিত হইবেন যে আপনাদের প্রিয় আরিফ জেবতিক এখন একজন সরকার স্বীকৃত 'নির্যাতিত লেখক।' তিনি ভিকারুন্নেসা স্কুলের পক্ষে একটি লেখা লেখিয়া খুলনার যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক গোর্কি সাহেবের পরিবারের সম্মান হানি করিয়াছেন বলিয়া অদ্য বৈকালে খুলনার আদালতে বি-রা-ট ক্ষতিপূরণ মামলা হইয়াছে। মামলা করিয়াছেন গোর্কি সাহেবের বোন। তবে আল্লাহর কাছে হাজার কৃতজ্ঞতা এই মহিলা মামলায় উল্লেখ করিয়াছেন যে 'লিখিয়া' উনার সম্মানহানি করিয়াছি, অন্য কোনো উপায়ে নহে। তা না হইলে আমার খবর আছিল।
অদ্য যুবলীগ-ছাত্রলীগ বৃন্দ হুমকি দিয়াছেন যে মামলার আসামি হিসাবে যদি খুলনায় পা রাখি, তাহলে তাহারা আমার পা ভাঙ্গিয়া ফেলিবেন। আমি নিজের পা নিয়াও কিঞ্চিত চিন্তিত আছি। মামলায় মোট ক্ষতিপূরণ কতো চাহিয়াছেন, তাহা কাগজপত্রাদি হাতে না আসা পর্যন্ত পরিস্কার হওয়া যাইতেছে না। প্রাথমিক শুনা যাইতেছে যে ১শ কোটি টাকার মামলা হইয়াছে, আবার মতান্তরে তাহা ১ কোটি টাকা বলিয়াও শোনা যাইতেছে।
যাহাই হউক না কেন, আমি এই মর্মে ঘোষনা দিতেছি যে আমি এই মামলা এবং আমার ঠ্যাঙের উপর বাচ্চালীগদের হামলার বিরুদ্ধে লড়িব।
ভিকারুন্নেসা স্কুলে আমাদের বোন লাঞ্ছিত হইয়াছে এবং সরকারের কিছু লোক সেই ধর্ষককে লালন করিয়াছে। আমি এই ধর্ষকদের প্রতি আমার ঘৃণা পুণরায় উচ্চারণ করিতেছি। কোনো মামলা আর ঠ্যাঙ খুলে নেওয়ার হামলায় সেই ঘৃণা থেকে আমাকে সরানো যাবে না।
জাজাকাল্লাহু খায়রান। যাহারা লেখাটি পড়িবার টাইম পান নাই, তাহাদের জন্য এই খানে লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হইল।
------------
গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের বাইরের কোনো জেলা নয়
বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্কুলের নাম ভিকারুননিসা স্কুল। এই স্কুলের ছাত্রীরা শুধু পড়াশোনায় নয়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, খেলাধুলায়, বিতর্কে, সংস্কৃতিচর্চায় সারা দেশে স্বনামখ্যাত। এ রকম একটি স্কুলে নিজের মেয়েকে ভর্তি করতে পারা অভিভাবকদের স্বপ্নের মতো একটি ব্যাপার। এ জন্য হ্যাপা কম পোহাতে হয় না। কথা ফোটার আগেই ভর্তি কোচিং শুরু হয়ে যায় এই স্কুলের ছাত্রীদের। ইদানীং অবশ্য কোচিং নেই, তবে লটারির নামেও নানা তেলেসমাতির খবর কানে আসে সাধারণ মানুষের।
এ রকম একটি স্কুলে, রাজধানীর মাঝখানে এক কিশোরী লাঞ্ছিত হয়েছে! পশুদের কোনো স্থান-কাল-পাত্র নেই, সারা দেশেই পাশবিক যৌন নির্যাতকরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুতরাং ভিকারুননিসা স্কুল সেই ছোবল থেকে বাদ পড়বে_এমনটা দুরাশা মাত্র। কিন্তু ব্যাপারটি সেই নির্যাতন নয়, ব্যাপার হচ্ছে নির্যাতন পরবর্তী সময়ের আচরণগুলো।
ভিকারুননিসা স্কুলের বসুন্ধরা শাখার প্রধান স্পষ্টতই গোটা ব্যাপার ধামাচাপা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। এতে সায় আছে ভিকারুননিসা স্কুলের মূল ম্যানেজমেন্টেরও। কে জানে, স্কুল সভাপতি রাশেদ খান মেননও এই ধর্ষকদের পক্ষেই কলকাঠি নাড়ছেন কি না! অন্তত তার কোনো জোরালো ভূমিকা তো দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ কী? হঠাৎ করেই ভিকারুননিসা স্কুল কর্তৃপক্ষ এই ধর্ষক ও নির্যাতকের পক্ষে জান কোরবান করে দিচ্ছে কেন? উত্তর একটাই। অভিযুক্ত শিক্ষক পরিমলের বাড়ি গোপালগঞ্জ।
শুধু এক পরিমলই নয়, ওই স্কুলের আরো পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন অভিভাবকরা। অভিযুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে বরুণ চন্দ্র বর্মণের বিরুদ্ধে বাণিজ্য বিভাগের দশম শ্রেণীর ছাত্রীরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে গত ২৭ জুন। ওই লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, 'বরুণ চন্দ্র বর্মণ ক্লাসে অশ্লীল-কুরুচিপূর্ণ শব্দ ব্যবহার ও বাজে ধরনের ইঙ্গিত দেন ছাত্রীদের।' তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত বরুণ চন্দ্র বর্মণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে, এই অভিযুক্ত শিক্ষকদের প্রত্যেকের বাড়ি গোপালগঞ্জ। এই বিশেষ জেলায় বাড়ি হওয়ায় পুলিশ কোনো তৎপরতা দেখাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন অভিভাবকরা।
আমাদের মননে এমন একটি ভাব তৈরি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আমলে গোপালগঞ্জে বাড়ি থাকা যেকোনো লোকই এঙ্ট্রা খাতির পাবে! এই ধারণা ভয়ংকর। ভিকারুননিসা স্কুলে একসঙ্গে পাঁচ অবিবাহিত শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়া, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পরও ব্যবস্থা না নেওয়া এবং উল্টো অভিভাবক ও ছাত্রীদের হুমকি দেওয়া এবং কর্তৃপক্ষের তৎপরতা_সব মিলিয়ে এক বিবষিমাময় পরিস্থিতি তৈরির পেছনে এই গোপালগঞ্জ শব্দটি যদি কাজ করে থাকে, তাহলে বিষয়টি চরম হতাশার।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গোপালগঞ্জ, শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে গোপালগঞ্জের প্রতিনিধিত্ব করেন; কিন্তু এই কারণে, গোপালগঞ্জ বাড়ি এই অজুহাতে কেউ আলাদা খাতির পেতে থাকলে সেটি বঙ্গবন্ধুর 'বাঙালিত্ব' চেতনার অপমান করা হয়। বঙ্গবন্ধু সারা জীবনই আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন, তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সারা বাংলাদেশকেই তাঁর নিজের দেশ হিসেবেই বিবেচনা করে এসেছেন, তবুও গোপালগঞ্জের দোহাই দিয়ে অপকর্ম করণেওয়ালাদের এই আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি নিয়ে আওয়ামী লীগের সতর্ক হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
ইদানীং টেলিভিশনে একটি বেসরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। সেখানে বলা হয়, 'অমুক দ্বীপটি বাংলাদেশের বাইরের কোনো দ্বীপ নয়।' একইভাবে আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির কর্তা ব্যক্তি, যাঁরা গোপালগঞ্জের দোহাই শুনেই গলে যান, তাঁদেরও মনে রাখা উচিত, গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের বাইরের কোনো জেলা নয়। এই জেলার লোকদের জন্য সাত খুন মাফ, এমন কোনো আইন কোথাও নেই।কয়েকজন দুষ্কৃতকারীকে রেহাই দিয়ে গোটা গোপালগঞ্জ জেলাবাসীকে অপমান করার কোনো মানে হয় না। রাজনীতিতে আত্মীয়-সম্পর্ক ভয়ানক খারাপ পরিণতি ডেকে আনে। যে নেতাই নিজের আত্মীয়-কুটম দ্বারা প্রভাবিত হন, তিনিই শোচনীয়ভাবে জনধিকৃত হন। ইতিহাসে এর ভুরিভুরি প্রমাণ আছে, নতুন করে সেই উদাহরণ টেনে কাউকে বিব্রত করতে চাচ্ছি না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এসব পরগাছাই একটি রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদের সারা জীবনের অর্জনকে চুষে খেয়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলে।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানিকের কথা। ছাত্রলীগের এই নেতা ক্যাম্পাসে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন করেছিল। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার মানিকের জন্য কোনো দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করেনি, বরং লোক দেখানো তদন্তের পর তাকে নিরাপদে সরে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। মানিক এই সুবিধা পেয়েছিল ছাত্রলীগ নেতা বলেই। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কি ভেবে দেখেছেন কখনো, এই মানিকপ্রেম তাঁদেরকে কী দিল? মানিক চলে গেছে মানিকের পথে, সে দলের খাতিরে এখন বিদেশে বসে আরাম-আয়েশে দিন গুজরান করছে। কিন্তু মানিকের কলঙ্ক তিলক ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় সারা বাংলাদেশে ধ্বনিত হয়েছে। সেই তিলক এখনো লেপ্টে আছে আওয়ামী লীগের কপালে। অথচ মানিকের বিচার নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগ তিলক নয়, টুপিতে উজ্জ্বল একটি পালক যুক্ত করতে পারত।
এ রকম স্বজনপ্রেমের ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনামলে। মানুষকে টুকরো টুকরো করে কেটে ম্যানহোলে ঢুকিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ নেত্রীর গুণধর পুত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেলকে অহেতুক নৃশংসভাবে হত্যা করেছে ডিবি পুলিশ, সে-ও আরেক আওয়ামী লীগ নেত্রীর ইন্ধনেই। এ রকম মাত্র কয়েকটি ঘটনায় আওয়ামী লীগ দ্রুত শক্ত পদক্ষেপ নিতে না পারায় রসাতলে গেছে তাদের বাদবাকি সব অর্জন। ২০০১ সালের নির্বাচনে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে দলটিকে।
একটি রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তার অনেক অর্জন এবং অনেক ব্যর্থতা থাকে। আশা করা হয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকারের এসব কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করেই পরবর্তী সময়ে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের দেশে তেমন হচ্ছে না। রাষ্ট্রক্ষমতা যতটা না পাল্টাচ্ছে সরকারের নিজস্ব সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাবে, তার চেয়ে বেশি পাল্টাচ্ছে বিশেষ দলের, বিশেষ জেলার, বিশেষ মানুষের আত্মীয়-পরিজনের পরিচয়ে। এই গোটা ব্যাপারটাই গোলমেলে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি খতিয়ে দেখবেন ভিকারুননিসা স্কুলের হঠাৎ করেই পাঁচজন অবিবাহিত গোপালগঞ্জের শিক্ষক নিয়োগ কি নেহায়েৎই কাকতালীয় ঘটনা, নাকি এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক যোগসূত্র আছে? প্রধানমন্ত্রী কি একটু খতিয়ে দেখবেন, গত আড়াই বছরে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদগুলোতে যে রদবদল হয়েছে, সেগুলোতে গোপালগঞ্জের লোক_এই দোহাই কত জন দিয়েছে?
সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি ও রেজিস্ট্রার হিসেবে, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীতে বড় কর্তা হিসেবে কারা নিজেদের বাড়ি গোপালগঞ্জ বলে অন্যায় সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন? তাঁদের সবার বাড়ি কি সত্যিই গোপালগঞ্জ? আর গোপালগঞ্জ বলেই কি তাঁরা ভালো পদে পোস্টিং নেওয়ায় কোনো অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবিদার?
গোপালগঞ্জ বাড়ি হলেই কি এক স্কুলছাত্রীকে নির্যাতন করে সেটি ভিডিও করে পকেটে নিয়ে বসে থাকা যায়? গোপালগঞ্জ বাড়ি হলেই কি নৌকা মার্কায় নির্বাচন করা রাশেদ খান মেনন তাঁর তথাকথিত সুশীলতা গিলে ফেলে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত ছিলেন?
রাজনীতি এখন জটিল হয়ে পড়ছে আবার। সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। গত আড়াই বছরের অর্জনগুলোকে সামলে রেখে সরকারকে আরো অনেক নতুন সাফল্য অর্জন করতে হবে। নইলে এর সব কিছুর জবাব দিতে হবে আগামী নির্বাচনে। এই সময়ে কোনো ব্যক্তিবিশেষের অপকর্মের দায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেওয়া ঠিক হবে না। আর তাই আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা কি একটু গভীরভাবে ভাববেন?
একদিকে গোপালগঞ্জ বাড়ির পাঁচ শিক্ষক, অন্যদিকে ভিকারুননিসা স্কুলের সহস্র সাবেক ও বর্তমান ছাত্রী এবং তাদের পরিবার। মাথা গুনুন প্রিয় নেতারা। বিশ্বাস করুন, ভোটের মাঠে এই পাঁচ স্ক্র্যাউন্ডেলের তুলনায় ভিকারুননিসার ওই নির্যাতিত ছাত্রী আর তার সহপাঠীরা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সব দিক বিবেচনা করে তাই সরকারের ওপর মহল থেকে এখনি সিগন্যাল ছড়িয়ে পড়ুক সারা বাংলাদেশে_ গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের বাইরের কোনো দ্বীপ নয়, ছাত্রলীগ-যুবলীগ বাংলাদেশের বাইরের কোনো সংগঠন নয়। কোনো ব্যক্তিবিশেষের অপকর্মের দায় তাই দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নেবে না।