Bengal Tiger 71
FULL MEMBER
- Joined
- Dec 23, 2016
- Messages
- 351
- Reaction score
- 0
- Country
- Location
দিল্লি- বেইজিংয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে ঢাকা
প্রতিবেশীদের কাজে লাগিয়ে ভারতকে একরকম ঘিরে ফেলার যে আগ্রাসী নীতি নিয়ে চলছে চীন, তাতে এপর্যন্ত একমাত্র বড় ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। ভারতেও অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, ঢাকা এখনও দিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে। এমনকি ভৌগোলিক ও মানসিক নৈকট্যের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা ভারতের দিকেই ঝুঁকে– কিন্তু দিল্লির কাছ থেকে সব সময় তারা এর উপযুক্ত প্রতিদান পাচ্ছে না, আক্ষেপ সেখানেই।
এর সবচেয়ে বড় সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলো— চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট। যে সঙ্কট খুব শিগগির ছয় মাস পূর্ণ করতে চলেছে।
দিল্লির সিভিল লাইনস এলাকায় ‘ইনস্টিটিউট অব চাইনিজ স্টাডিজ’ নামে যে বনেদী গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি আছে, সেখানে প্রতি মাসের একটি বুধবারে আয়োজিত হয় একটি আলোচনা সভা। গত মাসে (২৪ জানুয়ারি) সেই ‘ওয়েন্সডে সেমিনারে’র মূল বক্তা ছিলেন ড. জোনাথন ডি টি ওয়ার্ড, যাকে সারাদুনিয়া চেনে অন্যতম সেরা চীন-বিশেষজ্ঞ হিসেবে।
সেদিনের আলোচনায় ড. ওয়ার্ড একটা চমকপ্রদ পূর্বাভাস করেছিলেন, ‘বাষট্টি সালে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল হিমালয় সীমান্তে, মূলত অরুণাচলে। কিন্তু ভবিষ্যতে দুদেশের কখনও সংঘাত হলে দেখে নেবেন, সেটা কিন্তু হবে মূলত সমুদ্রকে ঘিরেই। কারণ, ভারত-চীনের উত্তেজনা ক্রমশ মেরিটাইম ডোমেইনে সরে আসছে, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।’
চীন যে ভারতকে দক্ষিণ দিক দিয়ে নানা দেশে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নৌবন্দর স্থাপন করে একরকম ঘিরে ফেলতে চায়, এটা অবশ্য নতুন কোনও কথা নয়। ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে এটিকে চীনের ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ বলেও বর্ণনা করে থাকেন, যে মুক্তোর হারে মুক্তোগুলো মালাক্কা প্রণালী থেকে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ,পাকিস্তান হয়ে হরমুজ প্রণালী ও সোমালিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।
ওদিকে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে চীনের ইকোনমিক করিডর গড়ার কাজও অনেকদূর এগিয়েছে। চীন থেকে শুরু হয়ে যে বাণিজ্যপথ আরব সাগরের উপকূলে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন আরও খবর পাওয়া যাচ্ছে, গোয়াদার বন্দর থেকে আরও ৮৫ কিলোমিটার পশ্চিমে জিওয়ানিতেও চীন একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে চলেছে, যেটি হবে জিবৌতির পরে বিদেশের মাটিতে চীনের দ্বিতীয় সেনা-স্থাপনা।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, পাকিস্তান তাদের ভূখণ্ডকে কার্যত চীনকে ইচ্ছেমতো ব্যবহারের জন্য তাদের হাতে একরকম তুলেই দিয়েছে। অনেকটা একই রকম অবস্থা শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারেও। আর এখানেই ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এক বিরল ব্যতিক্রম!
ভারতের সাবেক একজন শীর্ষ কূটনীতিক চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত চীনেও বহু বছর রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাঙালি এই সাবেক রাষ্ট্রদূতের বলতে দ্বিধা নেই, ‘বাংলাদেশে এসে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারের চেক লিখে দিয়ে গেছেন। তার পরেও ঢাকা সটান চীনের প্রভাব বলয়ে ঢুকে পড়েছে এটা কিন্তু মোটেও বলা যাবে না। চীনের দানখয়রাতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ভারতের নেই, এটা জেনেও শেখ হাসিনা সরকার কিন্তু এখনও পরিষ্কার ভারতের দিকেই ঝুঁকে আছে।’
তবে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলার ক্ষেত্রে সেই বাংলাদেশের প্রত্যাশাকে যে ভারত পূরণ করতে পারেনি, বাংলা ট্রিবিউনের কাছে প্রকারান্তরে সে কথাও স্বীকার করে নেন তিনি। চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত বলেন, ‘মিয়ানমারের অনুভূতিকে আমার মনে হয় একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু যে দেশটিকে লাখ লাখ শরণার্থীর বোঝা বইতে হচ্ছে, তাদের কথাকে ভারত আরও একটু বেশি গুরুত্ব দিলেই মনে হয় ভালো করত।’
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত নিরুপমা রাও মেননও সরাসরি স্বীকার করে নিচ্ছেন, মালদ্বীপ-শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানে চীন যেভাবে টাকাপয়সা ব্যয় করতে পারছে, সেই আর্থিক ক্ষমতা ভারতের নেই। ‘কিন্তু কূটনীতিতে টাকাপয়সাই সব নয়, তার পরেও আরও কিছু উপায় থাকে – যেটাকে বলা যেতে পারে স্মার্ট ডিপ্ল্যোমেসি। আমি মনে করি, দক্ষিণ এশিয়াতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর জন্য ভারতের উত্তর একটাই– আর সেটা হলো এই স্মার্ট ডিপ্ল্যোমেসি’, এই প্রতিবেদককে বলছিলেন নিরুপমা রাও।
কিন্তু আবারও সেই একই কথা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত যে নিজের প্রতিবেশে খুব একটা স্মার্ট ডিপ্ল্যোমেসির পরিচয় দিয়েছে, একান্ত আলোচনায় ভারতের কূটনীতিকরাও কেউই সে কথা বলছেন না।
অথচ গত কয়েকমাসে বিভিন্ন সার্কভুক্ত দেশে চীনের কর্মকাণ্ড দেখলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কেন বাংলাদেশের ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতিকে দিল্লির আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। কয়েকটা উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যেতেই পারে।
ক. ডিসেম্বরে মালদ্বীপ ও চীন নিজেদের মধ্যে একটি অবাধ বাণিজ্যচুক্তি (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষর করেছে। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিন যখন রাষ্ট্রীয় সফরে গত মাসে বেজিং গিয়েছিলেন, তখনই এই চুক্তি সই হয় এবং প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন চীনকে তাদের ‘ঘনিষ্ঠতম মিত্র’ বলে বর্ণনা করেন। এদিকে মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব ক্রমশ বিলীন হচ্ছে, এবং পুরোঅঞ্চলে এই একটিমাত্র দেশ আছে–যেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদি এখনও যাননি।
খ. ওই ডিসেম্বরের গোড়াতেই শ্রীলঙ্কা সরকার অনেক টালবাহানার পর তাদের হামবানটোটা বন্দরের লিজ ৯৯ বছরের জন্য তুলে দিয়েছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা চায়না মার্চেন্টস পোর্ট হোল্ডিংসের হাতে। স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দরটি চীনের অর্থায়নেই তৈরি হয়েছিল। তবে ভারত অনেক চেষ্টা করেছিল যাতে সেটির নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে না যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
গ. ভারত ও চীনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত যে স্থলবেষ্টিত নেপাল, সেখানে আবারও ক্ষমতায় আসছেন বামপন্থী রাজনীতিবিদ কে পি ওলি, যিনি তার চীন ঘনিষ্ঠতার (ও ভারত-বিরোধিতার) জন্য সুপরিচিত। ভাবী প্রধানমন্ত্রী ওলি চীনের সঙ্গে রেল যোগাযোগ সম্প্রসারিত করার কথা বলেছেন। চীনের সহায়তায় তিনি নেপালে আরও সড়ক, রেল প্রকল্প ও এয়ারপোর্ট গড়ে তুলতে চান। আর নেপালে ভারতের প্রভাব খর্ব করতে চীনও যে তাতে সানন্দে রাজি তা বলাই বাহুল্য।
ঘ. পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের নিয়ন্ত্রণ এখন পুরোপুরি চীনেরই হাতে। সেখান থেকে শুরু হয়ে কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে চীনের তৈরি করা চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর, যা আবার তাদের বেল্ট রোড ইনিশিয়িটিভের অংশ। এখন আবার জিওয়ানিতেও তৈরি হতে যাচ্ছে চীনা মিলিটারি বেস।
ঙ. মিয়ানমারেও কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে চীন। রাখাইনের সিতওয়ে বন্দর থেকে চব্বিশশো কিলোমিটার লম্বা গ্যাস পাইপলাইন বসিয়েছে নিজেদের সীমান্ত পর্যন্ত। মাত্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সমঝোতায় সই করেছে, সেটাও যে কার্যত চীনের ইশারায়, সে কথাও কারও অজানা নয়।
ফলে চীন যে চারদিক থেকে ভারতকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে, সে কথা এতটুকুও অতিরঞ্জিত নয়। ভুটান ছাড়া ভারতের প্রতিবেশী প্রায় সব দেশে তারা রীতিমতো শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে,আর আজ না-হোক কাল ভারতকে এর মোকাবিলা করতেই হবে তাতেও কোনও ভুল নেই। ভুটান ছাড়া শুধু যে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব অটুট, সেটি বাংলাদেশ।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার (অব) গুরমিত কানওয়াল এখন দিল্লির স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসে সিনিয়র ফেলো হিসেবে যুক্ত। তাই তার বলতে কোনও দ্বিধা নেই, ‘ভারতকে এখন সামরিকভাবে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ,নেপালের মতো দেশগুলোকে রিচ আউট করতে হবে। আফগানিস্তানের সেনাবাহিনীকে যেভাবে ভারত সাহায্য করছে, ঠিক সেভাবেই এই দেশগুলোকেও সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে।’
নিজের প্রতিবেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে ভারতের এছাড়া কোনও উপায় নেই, বাংলা ট্রিবিউনকে সে কথা খোলাখুলি বলছেন ব্রিগেডিয়ার কানওয়াল। তিনি আরও মনে করছেন, ‘যে কোনও কারণেই হোক ইন্দো-প্যাসিফিকে একটা সিকিওরিটি ভ্যাকুয়াম বা নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। চীন সেটার ফায়দা নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এখন ভারতের পক্ষে তার কাউন্টার-স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা ছাড়া উপায় নেই।’
অনেকটা একইসুরে ভারতকে আগেভাগেই সতর্ক করে দিচ্ছেন তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের প্রধান (‘সিলকিয়ং’) ড. লোবসাং সানগে। চীনের আগ্রাসী মনোভাবের মূল্য তিব্বতি জনগোষ্ঠীকে যেভাবে চোকাতে হয়েছে, তেমন দাম বোধহয় আর কাউকেই দিতে হয়নি। ফলে চীনের মনোভাব বোঝার জন্য তিব্বতি নেতৃত্বের মূল্যায়ন বোধহয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
সেই ড. সানগে এদিন তাদের নির্বাসিত সরকারের রাজধানী ধরমশালা থেকে টেলিফোনে বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘আমি মনে করি, ভারতকে এখনই সাবধান হতে হবে। ওদিকে পাকিস্তান থেকে শুরু করে নেপাল-বাংলাদেশ-বার্মা-শ্রীলঙ্কা হয়ে চীন একেবারে গোল করে ভারতকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে, অনেকটা সফলও হয়েছে। কাজেই ভারতকে এখনই এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর পথও খুঁজতে হবে।’
ফলে পর্যবেক্ষক-কূটনীতিক বা রাজনৈতিক মহলের পরামর্শের সারকথা একটাই, চীনের প্রভাব বলয়ের সঙ্গে টক্কর নেওয়ার জন্য ভারতকেও এখন অনেক বেশি সাবধানী, সপ্রতিভ ও সংবেদনশীল পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে হবে। আর সেই কূটনৈতিক অভিযানে নিশানার কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই থাকতে হবে বহু বছরের পরীক্ষিত বন্ধু বাংলাদেশকে।
প্রতিবেশীদের কাজে লাগিয়ে ভারতকে একরকম ঘিরে ফেলার যে আগ্রাসী নীতি নিয়ে চলছে চীন, তাতে এপর্যন্ত একমাত্র বড় ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। ভারতেও অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, ঢাকা এখনও দিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে। এমনকি ভৌগোলিক ও মানসিক নৈকট্যের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা ভারতের দিকেই ঝুঁকে– কিন্তু দিল্লির কাছ থেকে সব সময় তারা এর উপযুক্ত প্রতিদান পাচ্ছে না, আক্ষেপ সেখানেই।
এর সবচেয়ে বড় সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলো— চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট। যে সঙ্কট খুব শিগগির ছয় মাস পূর্ণ করতে চলেছে।
দিল্লির সিভিল লাইনস এলাকায় ‘ইনস্টিটিউট অব চাইনিজ স্টাডিজ’ নামে যে বনেদী গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি আছে, সেখানে প্রতি মাসের একটি বুধবারে আয়োজিত হয় একটি আলোচনা সভা। গত মাসে (২৪ জানুয়ারি) সেই ‘ওয়েন্সডে সেমিনারে’র মূল বক্তা ছিলেন ড. জোনাথন ডি টি ওয়ার্ড, যাকে সারাদুনিয়া চেনে অন্যতম সেরা চীন-বিশেষজ্ঞ হিসেবে।
সেদিনের আলোচনায় ড. ওয়ার্ড একটা চমকপ্রদ পূর্বাভাস করেছিলেন, ‘বাষট্টি সালে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল হিমালয় সীমান্তে, মূলত অরুণাচলে। কিন্তু ভবিষ্যতে দুদেশের কখনও সংঘাত হলে দেখে নেবেন, সেটা কিন্তু হবে মূলত সমুদ্রকে ঘিরেই। কারণ, ভারত-চীনের উত্তেজনা ক্রমশ মেরিটাইম ডোমেইনে সরে আসছে, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।’
চীন যে ভারতকে দক্ষিণ দিক দিয়ে নানা দেশে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নৌবন্দর স্থাপন করে একরকম ঘিরে ফেলতে চায়, এটা অবশ্য নতুন কোনও কথা নয়। ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে এটিকে চীনের ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ বলেও বর্ণনা করে থাকেন, যে মুক্তোর হারে মুক্তোগুলো মালাক্কা প্রণালী থেকে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ,পাকিস্তান হয়ে হরমুজ প্রণালী ও সোমালিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।
ওদিকে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে চীনের ইকোনমিক করিডর গড়ার কাজও অনেকদূর এগিয়েছে। চীন থেকে শুরু হয়ে যে বাণিজ্যপথ আরব সাগরের উপকূলে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন আরও খবর পাওয়া যাচ্ছে, গোয়াদার বন্দর থেকে আরও ৮৫ কিলোমিটার পশ্চিমে জিওয়ানিতেও চীন একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে চলেছে, যেটি হবে জিবৌতির পরে বিদেশের মাটিতে চীনের দ্বিতীয় সেনা-স্থাপনা।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, পাকিস্তান তাদের ভূখণ্ডকে কার্যত চীনকে ইচ্ছেমতো ব্যবহারের জন্য তাদের হাতে একরকম তুলেই দিয়েছে। অনেকটা একই রকম অবস্থা শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারেও। আর এখানেই ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এক বিরল ব্যতিক্রম!
ভারতের সাবেক একজন শীর্ষ কূটনীতিক চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত চীনেও বহু বছর রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাঙালি এই সাবেক রাষ্ট্রদূতের বলতে দ্বিধা নেই, ‘বাংলাদেশে এসে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারের চেক লিখে দিয়ে গেছেন। তার পরেও ঢাকা সটান চীনের প্রভাব বলয়ে ঢুকে পড়েছে এটা কিন্তু মোটেও বলা যাবে না। চীনের দানখয়রাতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ভারতের নেই, এটা জেনেও শেখ হাসিনা সরকার কিন্তু এখনও পরিষ্কার ভারতের দিকেই ঝুঁকে আছে।’
তবে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলার ক্ষেত্রে সেই বাংলাদেশের প্রত্যাশাকে যে ভারত পূরণ করতে পারেনি, বাংলা ট্রিবিউনের কাছে প্রকারান্তরে সে কথাও স্বীকার করে নেন তিনি। চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত বলেন, ‘মিয়ানমারের অনুভূতিকে আমার মনে হয় একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু যে দেশটিকে লাখ লাখ শরণার্থীর বোঝা বইতে হচ্ছে, তাদের কথাকে ভারত আরও একটু বেশি গুরুত্ব দিলেই মনে হয় ভালো করত।’
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত নিরুপমা রাও মেননও সরাসরি স্বীকার করে নিচ্ছেন, মালদ্বীপ-শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানে চীন যেভাবে টাকাপয়সা ব্যয় করতে পারছে, সেই আর্থিক ক্ষমতা ভারতের নেই। ‘কিন্তু কূটনীতিতে টাকাপয়সাই সব নয়, তার পরেও আরও কিছু উপায় থাকে – যেটাকে বলা যেতে পারে স্মার্ট ডিপ্ল্যোমেসি। আমি মনে করি, দক্ষিণ এশিয়াতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর জন্য ভারতের উত্তর একটাই– আর সেটা হলো এই স্মার্ট ডিপ্ল্যোমেসি’, এই প্রতিবেদককে বলছিলেন নিরুপমা রাও।
কিন্তু আবারও সেই একই কথা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত যে নিজের প্রতিবেশে খুব একটা স্মার্ট ডিপ্ল্যোমেসির পরিচয় দিয়েছে, একান্ত আলোচনায় ভারতের কূটনীতিকরাও কেউই সে কথা বলছেন না।
অথচ গত কয়েকমাসে বিভিন্ন সার্কভুক্ত দেশে চীনের কর্মকাণ্ড দেখলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কেন বাংলাদেশের ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতিকে দিল্লির আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। কয়েকটা উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যেতেই পারে।
ক. ডিসেম্বরে মালদ্বীপ ও চীন নিজেদের মধ্যে একটি অবাধ বাণিজ্যচুক্তি (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষর করেছে। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিন যখন রাষ্ট্রীয় সফরে গত মাসে বেজিং গিয়েছিলেন, তখনই এই চুক্তি সই হয় এবং প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন চীনকে তাদের ‘ঘনিষ্ঠতম মিত্র’ বলে বর্ণনা করেন। এদিকে মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব ক্রমশ বিলীন হচ্ছে, এবং পুরোঅঞ্চলে এই একটিমাত্র দেশ আছে–যেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদি এখনও যাননি।
খ. ওই ডিসেম্বরের গোড়াতেই শ্রীলঙ্কা সরকার অনেক টালবাহানার পর তাদের হামবানটোটা বন্দরের লিজ ৯৯ বছরের জন্য তুলে দিয়েছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা চায়না মার্চেন্টস পোর্ট হোল্ডিংসের হাতে। স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দরটি চীনের অর্থায়নেই তৈরি হয়েছিল। তবে ভারত অনেক চেষ্টা করেছিল যাতে সেটির নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে না যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
গ. ভারত ও চীনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত যে স্থলবেষ্টিত নেপাল, সেখানে আবারও ক্ষমতায় আসছেন বামপন্থী রাজনীতিবিদ কে পি ওলি, যিনি তার চীন ঘনিষ্ঠতার (ও ভারত-বিরোধিতার) জন্য সুপরিচিত। ভাবী প্রধানমন্ত্রী ওলি চীনের সঙ্গে রেল যোগাযোগ সম্প্রসারিত করার কথা বলেছেন। চীনের সহায়তায় তিনি নেপালে আরও সড়ক, রেল প্রকল্প ও এয়ারপোর্ট গড়ে তুলতে চান। আর নেপালে ভারতের প্রভাব খর্ব করতে চীনও যে তাতে সানন্দে রাজি তা বলাই বাহুল্য।
ঘ. পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের নিয়ন্ত্রণ এখন পুরোপুরি চীনেরই হাতে। সেখান থেকে শুরু হয়ে কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে চীনের তৈরি করা চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর, যা আবার তাদের বেল্ট রোড ইনিশিয়িটিভের অংশ। এখন আবার জিওয়ানিতেও তৈরি হতে যাচ্ছে চীনা মিলিটারি বেস।
ঙ. মিয়ানমারেও কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে চীন। রাখাইনের সিতওয়ে বন্দর থেকে চব্বিশশো কিলোমিটার লম্বা গ্যাস পাইপলাইন বসিয়েছে নিজেদের সীমান্ত পর্যন্ত। মাত্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সমঝোতায় সই করেছে, সেটাও যে কার্যত চীনের ইশারায়, সে কথাও কারও অজানা নয়।
ফলে চীন যে চারদিক থেকে ভারতকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে, সে কথা এতটুকুও অতিরঞ্জিত নয়। ভুটান ছাড়া ভারতের প্রতিবেশী প্রায় সব দেশে তারা রীতিমতো শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে,আর আজ না-হোক কাল ভারতকে এর মোকাবিলা করতেই হবে তাতেও কোনও ভুল নেই। ভুটান ছাড়া শুধু যে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব অটুট, সেটি বাংলাদেশ।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার (অব) গুরমিত কানওয়াল এখন দিল্লির স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসে সিনিয়র ফেলো হিসেবে যুক্ত। তাই তার বলতে কোনও দ্বিধা নেই, ‘ভারতকে এখন সামরিকভাবে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ,নেপালের মতো দেশগুলোকে রিচ আউট করতে হবে। আফগানিস্তানের সেনাবাহিনীকে যেভাবে ভারত সাহায্য করছে, ঠিক সেভাবেই এই দেশগুলোকেও সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে।’
নিজের প্রতিবেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে ভারতের এছাড়া কোনও উপায় নেই, বাংলা ট্রিবিউনকে সে কথা খোলাখুলি বলছেন ব্রিগেডিয়ার কানওয়াল। তিনি আরও মনে করছেন, ‘যে কোনও কারণেই হোক ইন্দো-প্যাসিফিকে একটা সিকিওরিটি ভ্যাকুয়াম বা নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। চীন সেটার ফায়দা নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এখন ভারতের পক্ষে তার কাউন্টার-স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা ছাড়া উপায় নেই।’
অনেকটা একইসুরে ভারতকে আগেভাগেই সতর্ক করে দিচ্ছেন তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের প্রধান (‘সিলকিয়ং’) ড. লোবসাং সানগে। চীনের আগ্রাসী মনোভাবের মূল্য তিব্বতি জনগোষ্ঠীকে যেভাবে চোকাতে হয়েছে, তেমন দাম বোধহয় আর কাউকেই দিতে হয়নি। ফলে চীনের মনোভাব বোঝার জন্য তিব্বতি নেতৃত্বের মূল্যায়ন বোধহয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
সেই ড. সানগে এদিন তাদের নির্বাসিত সরকারের রাজধানী ধরমশালা থেকে টেলিফোনে বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘আমি মনে করি, ভারতকে এখনই সাবধান হতে হবে। ওদিকে পাকিস্তান থেকে শুরু করে নেপাল-বাংলাদেশ-বার্মা-শ্রীলঙ্কা হয়ে চীন একেবারে গোল করে ভারতকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে, অনেকটা সফলও হয়েছে। কাজেই ভারতকে এখনই এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর পথও খুঁজতে হবে।’
ফলে পর্যবেক্ষক-কূটনীতিক বা রাজনৈতিক মহলের পরামর্শের সারকথা একটাই, চীনের প্রভাব বলয়ের সঙ্গে টক্কর নেওয়ার জন্য ভারতকেও এখন অনেক বেশি সাবধানী, সপ্রতিভ ও সংবেদনশীল পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে হবে। আর সেই কূটনৈতিক অভিযানে নিশানার কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই থাকতে হবে বহু বছরের পরীক্ষিত বন্ধু বাংলাদেশকে।