নিখোঁজের কোনো প্রমাণ
খুঁজে পাচ্ছে না হেফাজত
নিখোঁজের কোনো প্রমাণ<br> খুঁজে পাচ্ছে না হেফ&#
হায়দার আলী ও মুহম্মদ জয়নাল আবেদীন
রাজধানীর শাপলা চত্বর অভিযানে নিজেদের তিন হাজার নেতা-কর্মী নিখোঁজ হয়েছে বলে দাবি করেছিল হেফাজতে ইসলাম। ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় অনুসন্ধান চালিয়ে এসব নিখোঁজের তালিকা করা হবে। কিন্তু শতচেষ্টা করেও সেই তালিকা প্রকাশ করতে না পারায় তাদের দাবির যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে নিখোঁজদের তালিকা করতে গত ১১ মে সারা দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কমিটির নেতারা মাঠে নেমে পড়েন। মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় গিয়ে খোঁজখবর করা হচ্ছে। নিহত, আহত ও নিখোঁজ- এ তিনটি তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত সাত দিনে নিখোঁজ তালিকায় তাঁরা কতজনের নাম তুলতে পেরেছেন, তা জানার চেষ্টা করে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানী দল। যোগাযোগ করা হয় হেফাজতের কেন্দ্রীয় এবং তৃণমূলের বেশ কয়েকটি কমিটির নেতাদের সঙ্গে। তাঁরা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, নিখোঁজ আছে এমন একজনেরও সন্ধান পাননি তাঁরা গত সাত দিনে। সন্ধান পেলেই সেই তথ্য তাঁরা গণমাধ্যমে জানিয়ে দেবেন।
সূত্র জানায়, তালিকা তৈরি করতে গিয়ে হেফাজত নেতারা জানতে পারছেন, শাপলা চত্বরে অভিযানের মুখে মাদ্রাসার বহু ছাত্র ছত্রভঙ্গ হয়ে দিগ্বিদিক পালিয়ে যায়। এরপর নিজেদের উদ্যোগেই তারা নিরাপদ অবস্থান খুঁজে নিতে থাকে। কেউ কেউ নিজেদের বাড়ি বা আত্মীয়স্বজনের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়। প্রথমদিকে ওই ছাত্রদের মাদ্রাসায় না পেয়ে তাদেরই নিখোঁজ বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। পরে তাদের সবাই নিজ নিজ মাদ্রাসায় ফিরেছে। বিভিন্ন স্থানে তালিকা করতে গিয়ে এমন তথ্য পেয়ে হেফাজত নেতারা এখন বেশ অস্বস্তিতেই পড়েছেন। হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আশরাফ আলী নিজামপুরী গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন স্থান থেকে দুই-তিনজন করে নিখোঁজের নাম আসছে। তবে এর সঠিক সংখ্যা তিনি এখনো জানেন না। নিখোঁজের তথ্য পেলেই গণমাধ্যমকে জানানো হবে। দলের কার্যক্রম এখন কিছুটা ঝিমিয়ে আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারের প্রতি দেওয়া ১৩ দফা দাবি পূরণ না হওয়ায় গত ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে হেফাজতে ইসলাম। সেদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। রাজধানীজুড়ে চলে নজিরবিহীন তাণ্ডব। দিন, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতেও মতিঝিলের শাপলা চত্বর দখলে রাখে হেফাজতের হাজার হাজার কর্মী। পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। পরে মধ্য রাতের পর যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় তারা। অভিযানে নিজেদের প্রায় তিন হাজার কর্মী নিহত বা নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করে পরদিন ৬ মে বিবৃতি দেয় হেফাজতে ইসলাম। এ নিয়ে দেশজুড়ে হইচই শুরু হয়।
হেফাজতের টাঙ্গাইল জেলার সদস্য সচিব মুফতি আবদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মতিঝিলে হেফাজতের সেই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে পায়ে মারাত্মক ব্যথা পাই। আমার মতো অনেকেই পুলিশের হামলা থেকে বাঁচতে গিয়ে আহত হয়েছে। টাঙ্গাইল জেলায় কেউ নিখোঁজ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কর্মসূচিতে যাওয়ার পর প্রাণ বাঁচাতে সবাই ছোটাছুটি করে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে লুকোয়। অনেকেই নিজের বাড়িতে চলে যায়, কেউবা আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে ওঠে। আমাদের জেলায় ২০ থেকে ২৫ জন নিজ নিজ স্টেশনে (মাদ্রাসায়
উপস্থিত ছিল না। তবে যতটুকু জানি তাদের সবাই এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসে। এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট করে কেউ নিখোঁজ আছে কি না সেটাও আমরা খতিয়ে দেখছি।'
সেদিনের হামলা-অগ্নিসংযোগ এবং কোরআন পোড়ানোর ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, 'হেফাজতে ইসলাম মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। আমাদের ধারণা বিএনপি-জামায়াতের লোকজন ছদ্মবেশে আমাদের সমাবেশে ঢুকে এই নৈরাজ্য চালিয়েছে। কিংবা অন্য কোনো পক্ষ এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। মানুষের দুর্ভোগ হয়- এমন কাজ হেফাজতে ইসলাম করে না। আপনারা দেখেছেন, মানুষের দুর্ভোগের কথা মাথায় রেখে আমরা হরতালও প্রত্যাহার করেছি।'
হেফাজতের নোয়াখালী জেলা শাখার সেক্রেটারি ও বেগমগঞ্জ কালিকাপুর মাদ্রাসার মুহাদ্দেস মাওলানা ইয়াকুব কাছেমী বলেন, 'মতিঝিলের ঘটনায় আমাদের জেলায় দুজন নিহত এবং কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছে। কতজন নিখোঁজ আছে, এর সঠিক সংখ্যা জানতে উপজেলা কমিটির মাধ্যমে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা নিখোঁজ একজনেরও খোঁজ পাইনি। কেউ নিখোঁজ থাকলে সেটা চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই জানতে পারব।'
চাঁদপুর জেলার হেফাজতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আনোয়ারুল করিম বলেন, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে নিখোঁজের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। কমিটির লোকজন বিভিন্ন মাদ্রাসায় খোঁজখবর নিচ্ছে। তবে গত সাত দিনে কোনো নিখোঁজের সন্ধান মেলেনি। কমিটির কাজ শেষ হলেই কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
বৃহত্তর দাউদকান্দি (হোমনা, মেঘনা ও তিতাস
স্বল্প পেন্নাই জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল ও হেফাজতের দাউদকান্দি উপজেলা সেক্রেটারি মাওলানা নাজির আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে কাজ চলছে। বিভিন্ন মাদ্রাসায় খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। দাউদকান্দির কোনো মাদ্রাসায় নিখোঁজ পাওয়া যায়নি।
হেফাজতের কুমিল্লা জেলা শাখার সেক্রেটারি ও কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং কুমিল্লা কাসেমুল উলুম মাদ্রাসার সায়খুল হাদিস মাওলানা আশ্রাফ আলী বলেন, '৫ মে শাপলা চত্বরে কুমিল্লার ১৬ উপজেলা থেকে প্রায় ২০ হাজার নেতা-কর্মী গিয়েছিল। সেদিন আমি অসুস্থ থাকায় যেতে পারিনি।' কুমিল্লা জেলা কমিটির সভাপতি সোয়াগাজী বটগ্রাম মাদ্রাসার মোহতামিম (অধ্যক্ষ
মাওলানা নুরুল হক তাদের তদারকি করেছেন।
তিনি আরো বলেন, 'আমরা খবর পেয়েছি দাউদকান্দির একজন নিহত হয়েছে। আহত কয়েক শতাধিক। তবে কতজন নিখোঁজ আছে, প্রতিটি মাদ্রাসায় গিয়ে আমাদের লোকজন তদন্ত না করা পর্যন্ত বলা সম্ভব না। অনেকে গ্রেপ্তারের ভয়ে এলাকাছাড়া। আমি আপনার মাধ্যমে একটি বিষয় বলতে চাই। ৫ মে রবিবার হেফাজতের ব্যানারে যারা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ন্যক্কারজনক কাজ করেছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে তাদের গ্রেপ্তার করা হোক।'
হেফাজতের চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া সমন্বয় কমিটির সেক্রেটারি মাওলানা শোয়াইব চৌধুরী বলেন, 'কেন্দ্রীয় কমিটির লিখিত চিঠি পেয়ে আমরা সাত দিন ধরে কাজ করেছি। কিন্তু কোনো নিখোঁজ ছাত্রের নাম পাইনি। আমরা আবারও খোঁজখবর নেব।'
মানিকগঞ্জ জেলা হেফাজতের আমির সদর উপজেলা আবু হুরাইরা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা সাঈদ নূরের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে ওই কমিটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মানিকগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নিখোঁজের প্রমাণ মেলেনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া হেফাজতের সদস্য সচিব মুফতি মো. মোবারক উল্লাহসহ একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর এলাকায় হেফাজতের কমিটির নেতৃস্থানীয়দেরও পাওয়া যায়নি। তবে ওইসব কমিটির একাধিক সদস্য নিশ্চিত করেছেন, সেখানেও গত সাত দিনে কোনো নিখোঁজের সন্ধান মেলেনি।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন অরণ্য ইমতিয়াজ, টাঙ্গাইল; শামসুল হক মিরন, নোয়াখালী; ফারুক আহাম্মদ, চাঁদপুর; সাব্বিরুল ইসলাম সাবু, মানিকগঞ্জ; ওমর ফারুক মিয়াজী, দাউদকান্দি ও মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সাতকানিয়া]