সরকারের রাখঢাক এবং মিডিয়ার হাঁকডাক
12 July 2014, Saturday
মিনার রশীদ
minarrashid@yahoo.com
পঞ্চম ইন্দ্রিয়ের পর মানুষের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় রয়েছে। সেটা প্রয়োগ করে এ দেশের মানুষ উপলব্ধি করেছে, সমুদ্রসীমার রায় নিয়ে সরকার যেন কিছু একটা লুকোতে চাচ্ছে। সমুদ্রসীমার রায় হস্তান্তর করা হয়েছে ৭ জুলাই। কিন্তু তা ৮ তারিখের আগে প্রকাশ করা যাবে না মর্মে সালিশি আদালতের এই নির্দেশ একটু অস্বাভাবিক লেগেছে। দু’টি পক্ষের কাছে রায় হস্তান্তরের পর সালিশি আদালতের পক্ষ থেকে আবার তা পরের দিন দুপুর পর্যন্ত প্রকাশ না করার নির্দেশের মধ্যেই এই কিছু একটা লুকিয়ে থাকতে পারে। মাঝখানের এই এক দিন সময় সরকারের বিশেষ প্রস্তুতির জন্যই কি নেয়া হয়েছে?
শুধু সরকারের মধ্যে এই রাখঢাক নয়, সরকার প্রভাবিত মিডিয়া জগতেও একটি বিশেষ হাঁকডাক লক্ষ করা গেছে। বর্তমান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পরপর দেশের দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো সাথে সাথেই তাদের অনলাইনে তাজা খবরটি পরিবেশন করেছে। এই তরতাজা খবর পরিবেশনে সব পত্রিকা আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় একই শিরোনাম ব্যবহার করেছে। ৮ জুলাই সংবাদ সম্মেলনের পরপর পত্রিকাগুলো তাদের অনলাইনে যে শিরোনামগুলো দিয়ে এই সংবাদ প্রকাশ করে তা নিম্নরূপ :
সমুদ্রে সাড়ে উনিশ হাজার বর্গকিলোমিটার পেল বাংলাদেশ (প্রথম আলো)
ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধের রায়, বাংলাদেশের জয় (দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন)
সমুদ্রসীমার রায় : তালপট্টির ১৯ হাজার বর্গ কিমি. পেল বাংলাদেশ (দৈনিক যুগান্তর)
সমুদ্রসীমার রায় : তালপট্টির ১৯ হাজার বর্গ কিমি. পেল বাংলাদেশ (দৈনিক ভোরের কাগজ)
ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা মামলার রায় : বাংলাদেশ পেল ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার (দৈনিক সমকাল )
ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা মামলার রায় প্রকাশ : সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার পেল বাংলাদেশ (ইত্তেফাক)
সমুদ্রসীমা : বাংলাদেশ পেল সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার ( বিডি নিউজ-২৪ ডটকম )
Maritime Dispute with India Bangladesh gets 19,467 sq km area in the Bay (Daily Star)
শিরোনামগুলোর দিকে একটু সতর্ক দৃষ্টি ফেললে মনে হবে যেন কোনো একটি জায়গা থেকে সবাইকে একই কথা লেখার জন্য বলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তালপট্টির কথা জনগণের মগজে ও মনে আসার আগেই যেন উনিশ হাজার বর্গকিলোমিটার প্রাপ্তির সংবাদটি মগজে কিক করে। যে সংবাদটি জানার জন্য দেশের সর্বস্তরের জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, প্রথম মুহূর্তে সেই খবরটি না দিয়ে পত্রিকাগুলো তাদের পাঠকদের সাথেও প্রতারণা করেছে। তাও দুয়েকজন করেনি, সবাই দল বেঁধে করেছে। তবে প্রথম শ্রেণীর পত্রিকাগুলোর মধ্যে মাত্র নয়া দিগন্ত ও মানবজমিন ব্যতিক্রম। তাদের তাজা খবরের অন লাইন শিরোনাম ছিল নিম্নরূপ।
সমুদ্রসীমার রায় : তালপট্টি ভারতের (নয়া দিগন্ত)
দক্ষিণ তালপট্টি হারাল বাংলাদেশ (মানবজমিন)
আমি নিজেও আমার ফেস বুক পেইজে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পোস্টিং দিয়েছিলাম। শিরোনামটি ছিল, মদনের কলা ভাগ ও সমুদ্রসীমা নিয়ে আদালতের রায়। বিডি-টুডেডটনেট, তাজাখবর ডটকমসহ আরো কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা সেই লেখাটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে।
পরের দিন পত্রিকাগুলোর যে প্রিন্ট সংস্করণ বেরিয়েছে সেখানে তালপট্টির খবরটি অনেকে দিয়েছে। কিন্তু এর আগে লিখেছে যে তালপট্টি দ্বীপটি পানিতে তলিয়ে গেছে। মতিয়া চৌধুরী জানিয়েছেন, তালপট্টি নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। দীপু মনি জানিয়েছেন, ‘তালপট্টির কোনো অস্তিত্ব নেই। এই নামে কোনো দ্বীপ ছিল না। এটি ছিল নিম্ন প্লাবিত অঞ্চল।’
এখন এগুলো নিয়ে যারা উল্টাপাল্টা কথা বলবে তাদেরকে হয় জেলখানায় নয়তো বা হেমায়েতপুরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সরকার ও মিডিয়ার খবর পরিবেশনের যুগপৎ এই কসরতটি দেখে নিচের কৌতুকটি মনে পড়ে যায়।
এক লোক লটারিতে অনেক টাকা পায়। এক পিয়ন এসে বাড়িতে খবরটি দিয়ে যায়। কিন্তু খবরটি কিভাবে তাকে জানানো যায় তা নিয়ে পরিবারের সদস্যরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ভদ্রলোকের এক বন্ধুকে দিয়ে ধাপে ধাপে এই সংবাদটি জানানো হবে। প্রথমে অল্প থেকে শুরু করে। তারপর ধাপে ধাপে অঙ্ক বাড়িয়ে। বন্ধু বলে, আচ্ছা বন্ধু, তুমি যদি লটারিতে এক কোটি টাকা পাও তাহলে কী করবে? ভদ্রলোক অবিশ্বাসের হাসি দিয়ে বলেন, ‘ধ্যাৎ, এটা তো ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে কোটি টাকার স্বপ্ন দেখা। তার পরও যদি পেয়ে যাই, যাও প্রাপ্য টাকার অর্ধেক তোমাকে এখনই লিখে দিয়ে দেবো।’
এ কথা শুনে সেই বন্ধুই বেহুঁশ হয়ে পড়ে।
সরকার ও সরকারবান্ধব মিডিয়া ওপরের কৌতুকের মতোই ধাপে ধাপে তালপট্টি হারানোর এই দুঃসংবাদটি হজম করিয়েছে।
মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রজয়ের সংবাদ ঘোষণাটি ছিল আরো নাটকীয় ও চমকপ্রদ। জাতীয় সংসদের ভেতরেই প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কিছু দিন আগে মমতাজ সঙ্গীত পরিবেশন করলেও তার আগে দীপু মনি একটা চমৎকার নাটক করেছিলেন। এই নাটক দেখে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সারা দেশবাসী বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল।
ওই সময় বিষয়টি নিয়ে আমিও আমার কলামে লিখেছিলাম। দীপু মনির সেই সমুদ্র বিজয়ের ঘোষণাটি ছিল এক ছেলে বর্ণিত শাশুড়ির মুরগির সাইজের মতো। ছেলের কথা শুনে মা আঁৎকে ওঠেন, বাবারে মুরগি কি কখনো এত্ত বড় হয় ? লজ্জা পেয়ে ছেলে বলে, মা ওপরের হাতটির নিচে অন্য হাতটি রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। দীপু মনিও তার (সমুদ্র বিজয়) মুরগির সাইজ দেখাতে নিচে হাতটি রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন। কী হারিয়েছেন সেটা চেপে গিয়ে শুধু কী পেয়েছেন তা বলেছিলেন বলে সেই মুরগিটিকে হাতি বলে ভ্রম হয়েছিল।
এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে উভয়েরই জয় হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য মন্ত্রী এবং হানিফের মতো নেতারা তাদের স্বরেই সমুদ্র বিজয় নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে চলেছেন। নিজেদের মুরগির সাইজটি এক হাতে দেখাতে গিয়ে আওয়ামী লীগ বরাবরই তাকে হাতি বানিয়ে ফেলে।
সমুদ্রসীমা নির্ধারণ শেষ হয়ে গেছে। এখন আদালত থেকে যে রায় দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে অন্য কোথাও আপিল করা যাবে না। কাজেই যা কিছু করার তা আগেই করা প্রয়োজন ছিল। সঙ্গত কারণেই মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, প্রয়োজনীয় কাজগুলো আদৌ করা হয়েছিল কি না। কারণ প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং তা বলিষ্ঠভাবে পেশ করার জন্য যে রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও দক্ষতার প্রয়োজন ছিল, বর্তমান সরকারের মাঝে এই দু’টিরই মারাত্মক অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের ওপর থেকে সব আস্থা জনগণ হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিপক্ষের কাছ থেকে নেয়ার চেয়ে দেয়ার জন্যই এরা বেশি উদগ্রীব হয়ে থাকেন। শুধু দেয়ার এই মানসিকতা নিয়ে ঝানু প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কিছু আদায় করা আসলেই কঠিন। তা ছাড়া ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন এই সরকারকে ত্রাণকর্তার প্রতি আরো নতজানু বানিয়ে ফেলেছে। মাঝখান থেকে বিজেপি ক্ষমতায় এসে পড়ায় এই অবৈধ সরকারটি আরো বেকায়দায় পড়ে গেছে। পুরনো দেবতাকে যা যা দিয়েছিল নতুন দেবতাকে আরো বেশি নজরানা দেয়া দরকার হয়ে পড়ে। এমন প্রেক্ষাপট সামনে রেখেই আমাদের লাভ ক্ষতির হিসাবটি মেলাতে হচ্ছে। শুধু বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা নয়, যেকোনো নিরপেক্ষ গবেষণাতেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ওই ট্রাইব্যুনালের পাঁচজন বিচারকের মধ্যে ইন্ডিয়া একজন নিজস্ব লোককে নিয়োগ দিয়েছে (On 6 November 2009, India appointed Dr. Pemmaraju Sreenivasa Rao as a member of the Tribunal in accordance with subparagraph (c) of article 3 of Annex VII )। একইভাবে সুযোগ থাকার পরও বাংলাদেশ নিজ দেশের কাউকে নিয়োগ না দিয়ে পর পর দু’জন বিদেশী বিচারককে নিয়োগ দিয়েছে (On 8 October 2009, Bangladesh appointed Professor Vaughan Lowe QC as a member of the Tribunal in accordance with subparagraph (b) of article 3 of Annex VII . On 13 September 2010, Bangladesh appointed Judge Thomas A. Mensah in replacement of Professor Vaughan Lowe QC). বিবদমান পক্ষ থেকে একজন করে বিচারক বাছাই করার সুযোগ দেয়ার মধ্যে বিশেষ একটা উদ্দেশ্য ছিল। এই সুযোগটিকে ইন্ডিয়া পুরোপুরি কাজে লাগালেও আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। একজন দেশপ্রেমিক ইন্ডিয়ানের বিপরীতে একই পর্যায়ের একজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী না থাকায় ট্রাইব্যুনালের ভারসাম্য এক দিকে কাত হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। এটা কি নেহায়েত গাফিলতি নাকি মেজর হাফিজের কথামতো অনেকটা পাতানো খেলা?
আমাদের দেশে কি এই মাপের বিচারক বা আইনজ্ঞ একজনও খুঁজে পাওয়া যায়নি? যে কাজ নিজে করতে হয় তা শুধু পয়সার বিনিময়ে কামলা দিয়ে হয় না। এই মামলায় বিভিন্ন কলাকুশলীর জায়গায় বাংলাদেশ যেখানে মন্ত্রী, এমপি, পুরা সেক্রেটারি, খুচরা সেক্রেটারি, ডাইরেক্টর জেনারেল, আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স (কোনো র্যাংক বা পেশার প্রতি বিদ্বেষ থেকে বলছি না, রায়ের কপিটি দেখলে সহজেই চোখে পড়বে) দিয়ে ভরে ফেলেছে সেখানে ইন্ডিয়া তাদের দলটি নিজস্ব আইনজ্ঞ, হাইড্রোগ্রাফার, প্রফেসর দিয়ে সুসজ্জিত করেছে। ধারণা করা যায় যে, বিদেশী কামলাদের ওপর মূল কাজের ভারটি দিয়ে আমাদের আমলারা ছিলেন পিকনিক মুডে। ইন্ডিয়ার নিজস্ব বিশেষজ্ঞরা তাদের কাজটি যথাযথভাবে পালন করেছে এবং তার ফলটিও পেয়েছে। আমাদের যা প্রাপ্য ছিল তা আদায় করতে পারিনি। ইন্ডিয়া যতটুকু পাওয়ার তার থেকেও বেশি আদায় করে নিয়েছে।
আমাদের আমলাদের কাজ আমলারা করেছেন। অর্থাৎ তালপট্টি খুইয়ে এসেছেন। এখন পলিটিশিয়ানরা তাদের কাজ শুরু করেছেন। চাপার জোরে কেউ কেউ এখন তালপট্টি নামক দ্বীপটির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছেন। এখন তারা সমুদ্র বিজয় উদযাপন শুরু করে দিয়েছেন। এটা হয়েছে গ্রামের আবদুলের শহরে গিয়ে বিল্ডিং গণনার মতো। শহুরে এক টাউটকে ১০টি বিল্ডিং গুনে ৯টির দাম পরিশোধ করে। তারপরে সাথে থাকা স্ত্রীকে নিজের বাহাদুরি দেখায়, দেখলে তো কেমন ফাঁকিটা দিলাম।
এই মাথামোটাদের কে বোঝাবে যে এসব সালিশি আদালত কাউকে বিজয়ী বানায় না। এসব ট্রাইব্যুনাল চেষ্টা করে উপস্থাপিত তথ্য, উপাত্ত, যুক্তিতর্কের আলোকে যথাসম্ভব ন্যায্যভাবে দুই পক্ষের মধ্যে সমুদ্রসীমানা-সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসা করে দেয়া। কাউকে জয়ী বা বিজয়ী করার জন্য এই ট্রাইব্যুনাল কাজ করে না। এটা হলো আরবিট্রেশন, উদ্দেশ্য হলো দুই পক্ষের প্রতি সুবিচার করা। তবে কোন পক্ষ কিভাবে নিজেদের দাবি উপস্থাপন করে এবং ট্রাইব্যুনালকে কিভাবে বোঝাতে সক্ষম হয় তার ওপর নিজের প্রাপ্তি অনেকটা নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে ঝানু ইন্ডিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশের নেতৃত্ব ও অফিসারবর্গ বেশি সুবিধা নিতে পারবেন তা কোনো পাগলেও বিশ্বাস করবে না।
জাতিসঙ্ঘের দ্য নিপ্পন ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত Delimitation of maritime boundaries between adjacent States গ্রন্থে এই বিচারকদের কার্যপরিধি বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, The task of the judge is to produce an equitable and just result in the particular case. To reach such a result, the judge has to take into account the relevant circumstances of each case, not only by balancing the various circumstances, but also by balancing or composing the interests of the State in dispute.
অর্থাৎ বিচারকদের কাজ হলো যেকোনো বিশেষ মামলায় ন্যায্য ও সঠিক বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এ রকম ফল পেতে বিচারকেরা প্রতিটি মামলার সব পারিপার্শ্বিক অবস্থা গণনায় নেবেন। এই কারণে শুধু বিভিন্ন ঘটনার মধ্যেই ভারসাম্য টানেন না, বিবদমান দু’টি রাষ্ট্রের স্বার্থের মধ্যেও প্রয়োজনমতো ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
এই স্বার্থের ভারসাম্য বলে অনেক কিছু বোঝানো হয়েছে। এই স্বার্থের ভারসাম্য বলতে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সব ক্ষেত্রেই ভারসাম্য বোঝানো হয়েছে। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে ও গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রচ্ছন্ন হুমকিতে থাকা এই বিশাল জনগোষ্ঠী আরো সুবিচার দাবি করতে পারত। ইন্ডিয়ার রয়েছে বিশাল সমুদ্র এলাকা। সে তুলনায় বাংলাদেশের কাছে রয়েছে যৎসামান্য। যে ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার আমাদের এখান থেকে নিয়ে ভারতকে দেয়া হয়েছে তা বিশাল সমুদ্র এলাকার অধিকারী ভারতের জন্য কিছু নয়, কিন্তু আমাদের জন্য অনেক কিছু। এই কথাগুলো ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত একজন বাংলাদেশী বিচারক যে আবেগ ও অধিকারবোধ নিয়ে পেশ করতেন, কোনো বিদেশীর পক্ষে তা সম্ভব নয়।
তালপট্টি দ্বীপটি বাংলাদেশের জন্য স্ট্র্যাটেজিক্যালি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইন্ডিয়ার কাছ থেকে গায়ের জোরে এটি দখল করা বাংলাদেশের পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না। কাজেই এই ট্রাইব্যুনাল বিশেষ একটি সুযোগ আমাদের সামনে হাজির করে। সেই সুযোগটিকে আমরা ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। দ্বীপটি বাংলাদেশের ভাগে পড়লে অত্র অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হতো না। বরং মারাত্মকভাবে আন-ব্যালান্সড এই অঞ্চলের সামরিক পরিস্থিতি কিছুটা ব্যালান্সের দিকে সরে যেত।
কারণ কোনো একটি দেশ প্রতিবেশীর তুলনায় অত্যধিক দুর্বল হয়ে পড়লে সেখানে স্বভাবতই অবিচার ও অশান্তি দানা বাঁধে। অত্যধিক গরিবের মেয়ে পেলে অনেক নিষ্ঠুর স্বামী যেমন মনের সুখে পেটায়, প্রতিবেশী বেশি দুর্বল হলেও ব্যাপারটা তেমন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ তালপট্টি দ্বীপটি ইন্ডিয়াকে দিয়ে দেয়ায় অত্র অঞ্চলের এই গরিবের মেয়েটিকে আরো গরিব বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
এখন এই গরিবের মেয়ে মুখে কড়া লিপস্টিক মেখে ও অদ্ভুত সাজে সজ্জিত হয়ে সমুদ্র জয় হয়েছে বলে উল্লাস করছে। এর ফলে আরো কয় মণ কিলগুঁতো কপালে লেখা হয়ে গেছে তা মালুম করতে পারছে না।
বিষয়টিকে জনগণের বোধগম্য ভাষায় বর্ণনা করার জন্য আমি এক মদনের কলা ভাগ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছি। এক মদনের কাছে ২৫টি কলা রয়েছে। সেই কলা নিজের পৈতৃক সম্পত্তি থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু পাশের ক্ষেতের মধু নিজের অনেক কলা থাকার পরেও দাবি করল যে, এই মদনের ২৫টি কলাতে তারও একটা অধিকার রয়েছে। কাজেই আইনের পরিভাষায় মদনের এই ২৫টি কলা হয়ে পড়ল ডিসপুটেড বা বিরোধপূর্ণ কলা। এক সালিশ বোর্ড এসে মদন আর মধুর মধ্যে সেই কলা ভাগ করে দিলো। মদন পেল ১৯টি, আর মধু পেল ছয়টি কলা।
এখানে মধুর কোনো স্বত্ব আদতেই ছিল না। নেহায়েত চাপার জোর আর মেধার বলে সে ছয়টি কলা পেয়ে গেছে। মদন এখন খুশিতে ডুগডুগি বাজাচ্ছে যে, সে মধুর চেয়ে ১৩টি কলা বেশি পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই রায় মেনে নেয়ার জন্য মধু নিজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের আগেই মদন তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফেলেছে। তেমনিভাবে নিজের কলায় অপরের ভাগ সুনিশ্চিত করে মদনরা এর নাম দিয়েছে সমুদ্র বিজয়।
উৎসঃ
নয়া দিগন্ত
Share on facebook Share on email Share on print 5