গায়েবি ভোটে ৫০ শতাংশ উপস্থিতি দেখানোর নির্দেশনা : ফলাফলও প্রস্তুত রিটার্নিং কর্মকর্তাদের হাতে
7
গায়েবি ভোটে ৫০ শতাংশ উপস্থিতি দেখানোর নির্দেশনা : ফলাফলও প্রস্তুত রিটার্নিং কর্মকর্তাদের হাতে
ভোটার উপস্থিতি যাই হোক, যে কোনো মূল্যে ব্যালট বাক্স ভরার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সব কেন্দ্রে দিনভর একটি লাইন বজায় রাখা এবং প্রয়োজনে যেসব আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে সেসব এলাকা থেকে আ’লীগ কর্মী সমর্থকদের নিয়ে এসে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আর কেন্দ্র থেকে ফলাফল যাই পাওয়া যাক না কেন ‘গায়েবি ভোট’ দিয়ে ভোটার উপস্থিতি হার কম-বেশি ৫০ শতাংশ দেখাতে বলা হয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে। অপেক্ষাকৃত প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে গণমাধ্যম কর্মীদের যাতায়াত থাকবে না সেখানে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা কাগজে-কলমে বাড়ানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। কোন আসনে কাকে বিজয়ী ঘোষণা করতে হবে তাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক তথা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের। আওয়ামী লীগের কয়েকজন বিদ্রোহী প্রার্থীকে জেতানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। ঠিকঠাকমত নির্দেশনা অনুসরণ করলে রিটার্নিং ও সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তাদের (ডিসি ও ইউএনও) মোটা অংকের অর্থ দেয়া হবে প্রণোদনা হিসেবে ।
অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশে আজ অনুষ্ঠেয় তামাশার নির্বাচনী নাটকের শেষ দৃশ্যপটগুলো এভাবেই সাজানো হয়েছে। দেশ-বিদেশের সকল বিবেকবান মহলের অনুরোধ উপেক্ষা করে একদলীয় এবং প্রার্থীহীন এই নির্বাচনী মহড়ায় নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব আছে খুবই কম। যেটুকু আছে তাও নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাবেদ আলী ও দলবাজ কমিশন সচিবের। গণতন্ত্র হত্যার এ নির্বাচন কার্যত পরিচালনা করছেন মহাজোট সরকারের উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি টিম। তাদের নির্দেশনা মেনে কাজ করছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের সব ভোট কর্মকর্তা।
আজকের নির্বাচন নিয়ে সরকারি ব্লু-প্রিন্টের অংশবিশেষ প্রকাশ পেয়েছে যশোর-১ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের জবানীতে। পাতানো নির্বাচনের দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে আফিল উদ্দিন দলীয় নেতা কর্মীদের জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সাধারণ ভোটার উপস্থিতি লাগবে না। কেন্দ্রে কেন্দ্রে থাকবে দলীয় কর্মীদের সারি। দিনভর তারাই ভোট দেবেন পর্যায়ক্রমে। অন্তত ১০০ জন কর্মীর সারি রাখতে হবে সার্বক্ষণিক। নৌকা মার্কার এজেন্ট বা কর্মী তারা সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রে লাইন দিয়ে পর্যায়ক্রমে ভোট দেবেন। একজন ভোটকেন্দ্রে যাবেন। পেছনে ৯৯ জন অপেক্ষা করবেন। এভাবে সারা দিনই ওই ১০০ জন কর্মীই ভোট শেষ করবেন। সাংবাদিকরা এসে ছবি তুলে নিয়ে যাবেন। সবাই দেখবেন কেন্দ্রে পর্যাপ্ত ভোটার আছে’।
বুধবার সন্ধ্যায় যশোর-২ চৌগাছা ঝিকরগাছা সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এডভোকেট মনিরুল ইসলামের এক নির্বাচনী কর্মিসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলের শীর্ষ পর্যায়ের এ নির্দেশনার কথা জানান আফিল উদ্দিন। এ আসনে মনিরুলের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী আলহাজ রফিকুল ইসলাম।
শাসক দলের আরেক দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন, ভোটার আনার জন্য প্রয়োজনে টাকা খরচ করতে বলা হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের বলা হয়েছে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে ব্যালটের প্রতি সুবিচার করতে।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়তি দেখাতে ভোলার দুটি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া আসনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভোটার ভাড়া করার খবর পাওয়া গেছে গতকাল। চরফ্যাশন থেকে শ্রমিক লীগ ও যুবলীগ কর্মীরা ভাড়ায় ভোট দেয়ার চুক্তিতে ভোলা-৩ আসনে গেছেন বলে শ্রমিক লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র অনলাইন গণমাধ্যম শীর্ষনিউজকে জানিয়েছে। ভোলা-২ আসনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য ভোলা সদর থেকে ভোটার ভাড়া করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে।
শুক্রবার রাতে ভোলা-২ ও ভোলা-৩ আসনের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত করার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাপ প্রয়োগ করার অভিযোগ উঠেছে। আবার কোনো কোনো ভোটারকে কেন্দ্রে উপস্থিত না হতে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এ নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়া বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থক ও ভোটাররা আ’লীগ কর্মীদের হুমকিতে আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে বলে খবরে জানানো হয়েছে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেই এই নির্বাচনে। খালেদা জিয়া বন্দি গুলশানের বাসায়। ইকোনমিস্টের ভাষায়, এটাই হচ্ছে বাংলাদেশী গণতন্ত্রের নমুনা। জামায়াতে ইসলামীও নেই। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হলেও আপিল করায় তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। মহাজোটের পার্টনার ও গত ৫ বছরে সরকারের মিত্র এরশাদের জাতীয় পার্টিও নেই। প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে সরে গেছেন এরশাদ। পরিণতিতে হাসপাতাল নামক আধুনিক জেলখানায়। প্রভাব ও প্রলোভনে জবরদস্তিমূলকভাবে জাপার দালাল খণ্ডকে নির্বাচনে হাস্যকরভাবে রাখা হয়েছে। ইসলামপন্থী কোনো দল আজকের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যায় এবারই সর্বনিম্নসংখ্যক দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে। দেশে-বিদেশে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রত্যাখ্যাত নির্বাচন এটি।